আমরা প্রায় মানসিক স্বাস্থ্য অবনতি সম্পন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পারি। কেউ বা সহানুভূতি প্রদর্শন করি কেউ বা করি না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত লোক অবহেলা অবজ্ঞার, হাসি-তামাশার শিকার হন। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য মানবতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ করা এবং সমাজে অবদান রাখতে সাহায্য করে। আমরা অনেকেই বুঝে উঠতে পারি না এবং সময় মত সচেতন হই না। তাই দিন দিন মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে সর্বপ্রথম মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হয়। অনেক দেশ এই দিনটিকে মানসিক রোগ সচেতনতার সাপ্তাহের অংশ হিসেবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও নানাভাবে মানসিক স্বাস্থ্য নানা কর্মসূচি পালিত হয় কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে না মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা।
এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বিশ্বে প্রতি ৮ জনে ১ জন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং তরুণ সমাজ। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ৪ জনের ৩ জনই কোন পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পান না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭ লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করা মানুষের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশের বিষণ্নতা এবং প্রায় ৫ শতাংশ উদ্বেগজনিত রোগে ভুগছে। অথচ মানসিক রোগে আক্রান্ত ৯২ শতাংশ কোনো বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পান নি। আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ বছরের নিচে তরুণ তরুণীদের মানসিক রোগে আক্রান্তের হার প্রায় ১৩ শতাংশ। এদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপুল জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর স্বল্পতা, মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে শয্যা ও ঔষধ সংকট এবং বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য নগণ্য বরাদ্দ।
করোনাকালীন নানা সমস্যায় এবং চলতি বছরও জুলাই বিপস্নবে নানা কারণে অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ দারিদ্য, অসমতা, সহিংসতা বৈষম্য। এসব সমস্যাকে ভয় না পেয়ে বরং মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিকারের পথ খুঁজে বের করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং মানসিক চাপ মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকেও যথাযথ পরিচর্যা এবং সময় মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ মানসিক রোগীরা প্রায় জায়গায় অবহেলা- অবজ্ঞার শিকার। যার উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল নামে এক মানসিক রোগীকে পিটিয়ে হত্যা করা। তোফাজ্জলের মত এমন অনেক রোগী আছে যারা সমাজে নানাভাবে লাঞ্ছিত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে, যারা বেশিরভাগ সময়ে অন্যের কাছে হাসি তামাশার পাত্র হয়। অনেকে আবার বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। তাই পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে সকল স্তরে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানসিক রোগ নিয়ে গ্রামীণ সমাজে যে কুসংস্কার রয়েছে তা দূর করতে হবে এবং বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসায় উৎসাহিত করে তুলতে হবে। অনেকে মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারে না। তাই স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো উচিত। সরকারকেও মানসিক স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে কাজ করতে হবে। অনেক সরকারি হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসার বদলে মানসিক রোগীদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় এই বিষয়ে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। মানসিক চিকিৎসা সেবায় বাজেট বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ করা, রোগীর বিপরীতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষ অধিকার নয় বরং মৌলিক মানবাধিকার। তাই স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সুস্থ শরীরের পাশাপাশি মনও সুস্থ রাখতে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
নুসরাত সুলতানা : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়