যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। যে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যত বেশি সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাও তত বেশি। দেশের শ্রম, মেধা, মূলধন ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার দেশের দ্রম্নত শিল্পায়নে সহায়তা করে, জাতীয় আয় বৃদ্ধি করে এবং জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন করে। বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, মূলধন এবং প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ফলে, প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্ব্বেও বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোর কাতারে। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা, নদনদী, কৃষিজ সম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, মৎস্যসম্পদ ও শক্তিসম্পদ প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর বুকে জীবনের অস্তিত্ব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। দেশে দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকৃতি ও বিন্যাস ভিন্নতর। প্রাকৃতিক সম্পদের উপকরণসমূহ দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা তথা সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশেরও প্রধান কয়েকটি উলেস্নখযোগ্য 'প্রাকৃতকিসম্পদ' রয়েছে। এ প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে খনিজসম্পদ বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। বাংলাদেশ খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। প্রয়োজনের তুলনায় এ দেশে খনিজসম্পদের আহরণ পরিমাণ খুবই কম। ফলে, প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ খনিজসম্পদই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে খনিজসম্পদের মধ্যে- কয়লা, খনিজ তেল, চুনাপাথর, চীনামাটি, তামা, সিলিকা বালু, পারমাণবিক খনিজ পদার্থগুলো হলো জিরকন, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, লিউকক্সেন প্রভৃতি। এছাড়াও গন্ধক, নুড়ি পাথর, খনিজবালি (রেড়িও এক্টিভ সেন্ট), কঠিন শিলা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজসম্পদ হিসেবে লবণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে কোনো লবণের খনি না থাকলেও সমুদ্রের লোনা পানি আটকিয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোতে প্রচুর লবণ উৎপাদন করা হয়। এছাড়া, সর্বাপেক্ষা সহজ ও হালকা হাইড্রো-কার্বন মিথেন গ্যাস দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস গঠিত। প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজসম্পদ। সম্প্র্রতি বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) দেশে মজুত খনিজসম্পদের বাজার মূল্য নিরূপণ করেছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিকভাবে মজুত খনিজসম্পদের মূল্য ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন (২ লাখ ২৬ হাজার কোটি) ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৪১ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন (২ কোটি ৪১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০০ কোটি) টাকা। তবে জিএসবির এ হিসাবে দেশে মজুত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যকে ধরা হয়নি।
জিএসবির হিসাবের সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যকে বিবেচনায় নেয়া হলে দেশে মজুত খনিজসম্পদের নিরূপিত মূল্য আরও কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদ মজুত থাকলেও এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। খনিজসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে উদ্যোগী হলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস হতে পারে। আবার এগুলো দিয়ে চলমান জ্বালানি সংকটের সমাধান এমনকি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। দেশের খনিজসম্পদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ভূতত্ত্ববিদরা বলেন, 'দেশে মজুত খনিজসম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসই বড় পরিসরে উত্তোলন করা হচ্ছে। এখন এ গ্যাসের প্রমাণিত মজুত নিঃশেষ হয়ে আসছে। আমরা মনে করি, দেশে আরো গ্যাস আছে এবং তা উত্তোলন করা যাবে। উত্তরবঙ্গে পাঁচটি খনি আছে। এছাড়া, জয়পুরহাটে মাটির নিচে বিশাল আকারে চুনাপাথর আছে, এটাও উত্তোলন করা হয়নি।' পেট্রোবাংলার সাবেক কর্মকর্তা মো. ফরিদ উদ্দিন মার্কিন জ্বালানি অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড মেরিডিয়ানের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের সমুদ্র ও স্থলভাগে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ মজুত রয়েছে। বিশেষত গ্যাস ও কয়লার মজুতের বিষয়টি প্রমাণিত। এসব সম্পদ উত্তোলনে যথাযথ অনুসন্ধান ও বিনিয়োগ হয়নি। যে কারণে বছরের পর বছর গ্যাসের সরবরাহ কমার বিপরীতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে।'
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ খাতের এ বিশেষজ্ঞের ভাষ্যমতে, 'অন্য সম্পদের বিষয় বাদ দিলেও শুধু দেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলেই গ্যাস ও জ্বালানি তেল মজুতের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানের সুপারিশ থাকলেও সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দুঃখের বিষয় হলো জ্বালানি বিভাগ ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সেখানে চট্টগ্রামে অনুসন্ধানের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের উচিত প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাব্য এলাকায় যথাযথ বিনিয়োগ করে আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। নতুবা জ্বালানি খাত অনিশ্চয়তার মধ্যেই থেকে যাবে।' জিএসবিও বলছে, দেশে আবিষ্কৃত খনিজসম্পদের যে আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা হয়েছে, তা মূলত মজুত থেকে পাওয়া ধারণাগত একটি সংখ্যা। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা সম্ভব হলে খনিজসম্পদের পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি এ সম্পদের যথাযথ আকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি বাজারমূল্য অনুযায়ী সম্পদের প্রকৃত আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দাবি, জিএসবি দেশে আবিষ্কৃত আট ধরনের খনিজসম্পদের আর্থিক বাজারমূল্য নিরূপণ করেছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে কয়লা রয়েছে ৭২৫ কোটি টনেরও বেশি। বাজারমূল্য টনপ্রতি ১৭৫ ডলার হিসাব করলে এ পরিমাণ কয়লার দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার ৮৯০ কোটি ডলারে। এছাড়া, পিট কয়লার সম্ভাব্য মজুত রয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টন। প্রতি টন ৬০ ডলার হিসাবে এর মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার ৫৯০ কোটি ডলারে (৩৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন)। এছাড়া, চুনাপাথর রয়েছে ২ হাজার ৫২৭ কোটি টন। টনপ্রতি ৩০ ডলার হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৮১০ কোটি ডলার। কঠিন শিলা আছে ২০ কোটি ১০ লাখ টন- যার আর্থিক মূল্যমান ৫৪২ কোটি ডলার। ২৩ কোটি টন সাদামাটির মূল্য ২ হাজার ৯৯০ কোটি ডলার। কাচবালি আছে ৫১১ কোটি ৭০ লাখ টন- যার মূল্য ৬ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। ২২০ কোটি টন নুড়িপাথরের মূল্যমান ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার এবং সাড়ে ৬২ কোটি টন লোহার মূল্য ৬ হাজার ৮৮০ কোটি ডলার।
জিএসবির মহাপরিচালক বলেন, আমরা এসব সম্পদের একটি আনুমানিক মূল্য নির্ধারণ করেছি। এসব খনিজসম্পদের ল্যান্ড সার্ভে বা ফিজিবিলিটি স্টাডি হলে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যাবে। তখন অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে বা কমতেও পারে।' আবিষ্কৃত এসব খনিজসম্পদ উত্তোলন করা যাবে কিনা সে বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছে জিএসবি। বিশেষ করে কয়লা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো আবিষ্কৃত কয়লা খনির অবস্থান মাটির অনেক গভীরে। এত গভীরের কয়লা উত্তোলনের প্রযুক্তি এখনো বাংলাদেশে সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। জিএসবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খনিজসম্পদ মজুত সম্পর্কে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ১০ কোটি ২০ লাখ, রংপুরের খালাসপীরে ১৪ কোটি ৩০ লাখ এবং দিনাজপুরের দীঘিপাড়ায় ৪০ কোটি ২০ লাখ টন কয়লার মজুত রয়েছে। এছাড়া, পিট কয়লা মজুত রয়েছে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড়ে ২৮ কোটি ২০ লাখ টন, গোপালগঞ্জের বাঘিয়া-চান্দা বিলে ১৫ কোটি, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সাড়ে ৭ কোটি, শালস্নায় ৫ কোটি ২০ লাখ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে ৩ কোটি ২০ লাখ ও খুলনার কলামৌজায় ৮০ খাল টন। চুনাপাথর মজুতের বিষয়ে জিএসবি বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি চুনাপাথর মজুত রয়েছে উত্তরের জেলা নওগাঁয়। জেলায় তাজপুর, বদলগাছি, ভগবানপুরে আড়াই হাজার কোটি টনের বেশি চুনাপাথর মজুত রয়েছে। এছাড়া, জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট সদরে ১০, পাঁচবিবি উপজেলায় ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং সুনামগঞ্জের বাঘালীবাজারে ১ কোটি ৭০ লাখ, টেকেরঘাটে ১ কোটি ২৯ লাখ ও লালঘাটে ১ কোটি ২৯ লাখ টন চুনাপাথরের মজুত রয়েছে। খনিজসম্পদ হিসেবে মূল্যবান সাদামাটি রয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে সাড়ে ১২ কোটি টন, হবিগঞ্জের মাধবপুরে ৬ কোটি ৮০ লাখ টন, নেত্রকোনার বিজয়পুরে আড়াই কোটি টন। এছাড়া, দেশের আরও কয়েকটি জেলায় সাদামাটির মজুত চিহ্নিত হয়েছে। দেশের ছয় জেলায় বিপুল পরিমাণ নুড়িপাথর মজুতের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। এসব জেলায় নুড়িপাথরের মোট মজুতের পরিমাণ ২২০ কোটি টন। দিনাজপুরের হাকিমপুরে আকরিক লৌহ মজুত রয়েছে ৬৫ কোটি টন। এছাড়া, কাচবালির মজুত রয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টনেরও বেশি। এসব খনিজসম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহারে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হতে পারে।
ড. ফোরকান আলী : গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ