সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

গ্যাস-বিদু্যতে দুশ্চিন্তা : সমস্যা সমাধানে নজর দিন

দেশের শিল্প খাত মারাত্মকভাবে ধুঁকছে। আর তার প্রধান কারণ গ্যাস-বিদু্যতের সংকট। চাহিদার তুলনায় গ্যাস মিলছে অনেক কম। ফলে ব্যাপকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে, বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উৎপাদন। উদ্যোক্তারা ক্রমাগত লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছেন। এর ফলে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক শিল্পকারখানা।
আর কে চৌধুরী
  ০৫ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
গ্যাস-বিদু্যতে দুশ্চিন্তা : সমস্যা সমাধানে নজর দিন
গ্যাস-বিদু্যতে দুশ্চিন্তা : সমস্যা সমাধানে নজর দিন

একদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট, অন্যদিকে, আমদানি করেও চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় গ্রাহকরা গ্যাস পান না। এটা নতুন না, দীর্ঘদিন ধরেই এমনটা চলছে। ফলে, যাদের সামর্থ্য আছে, গ্যাসের লাইন থাকা সত্ত্বেও জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় তারা সিলিন্ডার রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ রাখছেন বৈদু্যতিক চুলা। কেউবা বৈদু্যতিক চুলা এবং সিলিন্ডার দুটোই। কারণ বিদু্যতেরও নিশ্চয়তা নেই। পাড়া-মহলস্নার অনেক বাড়ির উঠোনে গৃহবধূদের ইদানীং মাটির চুলায়ও রান্না করতে দেখা যাচ্ছে। গ্যাস পরিস্থিতি প্রকৃতই এমন হতাশাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, অনেক গ্রাহকই এখন মনে করেন, গ্যাসের লাইনটা তাদের জন্য অকারণ মাসিক ব্যয়ের একটা অর্থহীন দায়ে পরিণত হয়েছে। দরকারের সময় গ্যাস না পেয়েও মাসে মাসে নির্ধারিত টাকা গুনতে হচ্ছে।

দেড় দশকের স্বৈরশাসনে শীর্ষ ব্যক্তিরা এ খাত থেকেও চুরি-জোচ্চুরি, লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি আর অর্থপাচারে যতটা তৎপর ছিলেন, তার সিকিভাগ সক্রিয়তাও যদি গ্যাসের উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহে নিয়োগ করতেন, অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হতো। দুর্ভোগ কমত গ্রাহক সাধারণের। কিন্তু তা হয়নি। আর তা হয়নি বলেই, চলতি রমজানে গ্যাস-বিদু্যৎ সংকটে বিশেষভাবে ভুগতে হতে পারে বলে আশঙ্কা গ্রাহকদের। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বিদু্যতের লোডশেডিং শুরু হয়েছে। জ্বালানি সংকটে অনেক বিদু্যৎকেন্দ্রে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে পালস্না দিয়ে লোডশেডিং বৃদ্ধিরও আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলে ধর্মপরায়ণ মুসলিমদের সঙ্গে সর্ব সাধারণেরই কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। শুধু আবাসিক গ্রাহকদেরই সমস্যা নয়, গ্যাস-বিদু্যৎ সংকটের প্রভাব পড়তে পারে শিল্প-কলকারখানায়ও। এ দুই জ্বালানির উৎপাদন হ্রাস এবং চাহিদা বৃদ্ধির এই উভয় সংকট মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই প্রয়োজনীয় কিছু প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিলেও সার্বিক সমস্যা সমাধানে তা পর্যাপ্ত নয়। এজন্য কর্তৃপক্ষকে যেমন উৎপাদন-বিপণন-সরবরাহ সুষ্ঠু রাখা এবং সিস্টেম লস বন্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। অন্যদিকে, গ্রাহকের সচেতনতা এবং সহযোগিতাও প্রয়োজন। গ্যাস-বিদু্যতের অপচয় রোধ, পরিমিত ব্যবহারও নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য। পবিত্র রমজানে এ ক্ষেত্রও দাবি করে কৃচ্ছ্রসাধন।

দেশের শিল্প খাত মারাত্মকভাবে ধুঁকছে। আর তার প্রধান কারণ গ্যাস-বিদু্যতের সংকট। চাহিদার তুলনায় গ্যাস মিলছে অনেক কম। ফলে ব্যাপকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে, বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উৎপাদন। উদ্যোক্তারা ক্রমাগত লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছেন। এর ফলে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক শিল্পকারখানা। এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্যাস সংকটের কারণে বিভিন্ন শিল্পের উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তাদের মতে, গত কয়েক মাসে কয়েকশ' কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

কেবল আরএমজি সেক্টরেই ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অন্যদিকে, ক্রমাগতভাবে কমছে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন। আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি খুব একটা বাড়ানোর উপায় নেই। আমদানি বাড়াতে হলে নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে।

আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল স্থাপন ও চালু করার সম্ভাবনা কম। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গত শনিবার গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৬৯১ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩০৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সরবরাহ করা গ্যাসের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এসেছে এক হাজার ৯০৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে এসেছে ৭৮১ মিলিয়ন ঘনফুট। এদিকে, রমজান ও গ্রীষ্মে বিদু্যতের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। সেই বাড়তি চাহিদা পূরণে বিদু্যৎকেন্দ্রগুলোতে বেশি পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতে আগামী দিনে শিল্পে গ্যাস সংকট আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গ্যাস সংকটে শিল্প খাত যখন প্রবল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, রপ্তানি কমে যাচ্ছে, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন বাড়তি গ্যাস সরবরাহের বদলে সরকার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করছে। এরই মধ্যে শিল্পের জন্য নতুন করে আরও ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গত বুধবার গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বর্তমানে শিল্পকারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদু্যৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। নতুন শিল্পের জন্য এটি বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাবের ওপর শুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্যাস সংকটের পাশাপাশি জুলাই গণ-অভু্যত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার অভাবে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন অপ্রতুলতায় বিপুলসংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তা শিল্প খাতকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

দেশে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হলে কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়বে, অর্থনীতিতে বিপর্যস্ত হবে। তাই, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কাম্য হবে না, যা শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করবে।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে