নারীর অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন- এই তিনটি শব্দ কেবল নারীর উন্নয়নের প্রতিশ্রম্নতি নয়, একটি সমাজের ভিত্তি। ইতিহাসের পাতায় তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর ভূমিকা, স্বীকৃতি এবং মর্যাদার পরিবর্তন ঘটেছে। তবে বৈষম্যের শেকড় এখনো পুরোপুরিভাবে উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিস্তৃত হয়েছে, বিশ্ব যখন বৈশ্বিক সংযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে, তখনো নারীরা পৈতৃক সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি।
নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসে মৌলিক মানবাধিকার। একজন নারী যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা ও স্বাধীনতার অধিকার রাখেন, তেমনি সামাজিক ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও তার সমান অংশীদারিত্ব থাকা উচিত। অথচ আজও অনেক দেশে নারীরা মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হয়। 'শিক্ষার প্রসার' নারীর অধিকার নিশ্চিত করার প্রথম ধাপ। একজন শিক্ষিত নারী শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য কল্যাণকর ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু অনেক দেশে এখনো কন্যাশিশুর পড়াশোনাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, দারিদ্র্যের অজুহাতে তাদের শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করা হয়। অথচ জাতিসংঘের গবেষণা বলছে, একজন শিক্ষিত নারী তার পরিবার ও সমাজের জন্য বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হন।
অধিকার নিশ্চিতকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নারীর দেহ ও মন সংক্রান্ত স্বাধীনতা। নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকা উচিত। সে কী পোশাক পরবে, তার পেশা নির্বাচন, কীভাবে অর্থ আয় করবে বা কীভাবে তা ব্যয় হবে, কাকে বিয়ে করবে, কবে মা হবে অথবা আদৌ হবে কি না- এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধু নারীর হওয়া উচিত। অথচ আজও নারীর জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো অন্য কেউ নিয়ে থাকে, সমাজ তার ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে। গৃহস্থালি শ্রমের স্বীকৃতি না থাকা, কর্মস্থলে বৈষম্য, গার্হস্থ্য সহিংসতা ও যৌন হয়রানির মতো ঘটনাগুলো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা। ফলে, নারীরা যখন তাদের মৌলিক অধিকারগুলো পায় না তখন তাদের সম্ভাবনাও সীমিত থেকে যায়।
সমতার প্রশ্নটি নারীর সম্ভাবনাময়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য শুধু সামাজিক নয়, এটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সমান বেতন, নেতৃত্বের সুযোগ এবং কর্মপরিবেশে সমতা নিশ্চিত করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ দেশে এখনো নারীরা পুরুষের তুলনায় কম বেতন পান, একই ধরনের কাজ করলেও তারা সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত। নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে এই বৈষম্য দূর করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, পারিবারিক কাঠামোতেও সমতা জরুরি। একজন নারী যেমন সন্তান পালনের দায়িত্ব নেন, তেমনি পুরুষেরও সেই দায়িত্ব থাকা উচিত। কিন্তু আজও সমাজে সন্তান লালন-পালনকে এককভাবে নারীর দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়, যার ফলে তাদের কর্মজীবন ব্যাহত হয়। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন না হওয়ায় তারা কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে যান, যা অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। নারীর ক্ষমতায়ন কেবল অর্থনৈতিক বা শিক্ষাগত অগ্রগতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার সঙ্গেও জড়িত। সমাজে যদি প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হয়, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আইনগত সুরক্ষারও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অনেক দেশেই নারী নির্যাতনবিরোধী আইন থাকলেও তা কার্যকর হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লাগে, সামাজিক চাপের কারণে নারীরা তাদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেন না। যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার নারীরা প্রায়শই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। সমাজে প্রচলিত সংস্কার ও মানসিকতাও নারীর ক্ষমতায়নের পথে বড় বাধা। বহু বছর ধরে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা নারীদের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে আছে। অনেক সমাজেই এখনো বিশ্বাস করা হয়, নারীর মূল কাজ হলো ঘর সামলানো, সন্তান লালন-পালন করা এবং পরিবারের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা। কিন্তু এই মানসিকতা যত দিন পরিবর্তন না হবে তত দিন প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়ন মানে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয় বরং পরস্পরের পরিপূরক হয়ে সমাজকে এগিয়ে নেওয়া।
নারীর সম্ভাবনার বিস্তার ঘটাতে হলে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবারে যদি কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তবে বড় হয়ে সে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি লিঙ্গসমতা নিয়ে পাঠদান না করা হয়, তবে নতুন প্রজন্ম সেই পুরনো বৈষম্যের চক্র থেকে বের হতে পারবে না। কর্মক্ষেত্রে যদি নারীরা সমান সুযোগ না পান, তবে তাদের প্রতিভার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশ্ব আজ এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন সমাজকে নতুন রূপ দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীদেরও অগ্রসর হতে হবে। কেবল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করলেই সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। নারীর সম্ভাবনা সীমাহীন, তবে সেটি প্রসারিত করতে হলে প্রয়োজন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমতা এবং কার্যকর আইন ও নীতি। নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা মানে কেবল নারীর উন্নতি নয়, একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা।
মালিহা মেহনাজ : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা