দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে চলমান অস্থিরতায় রাজনৈতিক সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকলেও থামছে না নাশকতামূলক কর্মকান্ড, এতে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের অন্যান্য খাতের মতো সংস্কৃতি অঙ্গনে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে থিয়েটার পাড়া, টিভি নাটক নির্মাণ, সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে।
চলমান পরিস্থিতির কারণে ক্রমেই বেকার হয়ে পড়ছেন টিভি নাটক, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রর শিল্পীরা। কয়েক বছর আগেও যারা আলোচনায় ছিলেন, বছরে একাধিক নাটক, সিনেমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাদের বেশিরভাগেরই হাতে এখন কাজ নেই। কাজ না পেয়ে অনেকে আড়ালে চলে গেছেন, আবার কেউ কেউ কৌশলে সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। যারা টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তাদের অবস্থাও ভালো নয়। ছয় মাস, এক বছর এমনকি দুই বছরেও নতুন কাজে চুক্তিবদ্ধ হতে পারেননি কেউ কেউ। আগে চুক্তিবদ্ধ হওয়া কাজগুলো নিয়েই ব্যস্ত আছেন তারা। সংশ্লিষ্টদের ধারণা এই পরিস্থিতি আগামী বছরের প্রথম মাস পর্যন্ত চলবে।
জানা গেছে চলমান অবরোধ, হরতাল কর্মসূচির কারণে মঞ্চ নাটকের মহড়া, এবং নাটক মঞ্চায়নে বাধগ্রস্ত হচ্ছেন কর্মীরা। বছরের শেষ দিকে একাধিক উৎসবে মুখরিত থাকে থিয়েটারপাড়াখ্যাত শিল্পকলা একাডেমি, মহিলা সমিতি মিলনায়তন। সেখানেও উৎসবের কমতি দেখা গেছে। মিলনায়তনে প্রবেশের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে রাখা হচ্ছে দিনের বেশিরভাগ সময়। নামকাওয়াস্তে মাঝে মধ্যে নাটকের প্রদর্শনী হলেও দর্শক মিলছে না। অধিকাংশ থিয়েটার বা নাট্যদলের কর্মীই বেকার সময় কাটাচ্ছেন।
টিভি নাটকের শিল্পীদের অবস্থা আরও নাজুক। চ্যানেলগুলোর নিজস্ব প্রযোজনায় নাটক নির্মাণ অব্যাহত থাকলেও আতঙ্কে রয়েছেন শিল্পীরা। অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছেন। কাজ না থাকায় আয় রোজগারও কমে গেছে অনেকের। এতে বিপাকে পড়েছে তাদের পরিবার।
বছরের শেষে দিকের শীতকালীন নানা কনসার্টে মুখর থাকে রাজধানীসহ সারাদেশ। সেখানেও চরম ভাটা পড়েছে। সঙ্গীতশিল্পীরা বেকার সময় কাটাচ্ছেন। কনসার্ট নেই, সঙ্গীতসন্ধ্যা নেই, আয়োজন হচ্ছে না কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। ফলে বিপাকে পড়েছেন সঙ্গীত অঙ্গনের মানুষ। সাধারণত বছরের অক্টোবর থেকে শিল্পীদের স্টেজ শো'র ব্যস্ততা শুরু হয়। এবার তা একেবারেই কম। সঙ্গীতশিল্পীরা বলেন, কনসার্টের এই ভরা মৌসুম শুরু হয়েছে হতাশা দিয়ে। নাম প্রকাশ না করে একজন শিল্পী বলেন, অক্টোবরের শেষের দিক থেকে ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত আমাদের প্রচুর অনুষ্ঠান থাকে কিন্তু এখন তো একটার পর একটা অনুষ্ঠান স্থগিত হচ্ছে। এখন প্রায় সব শিল্পীই মিউজিক ভিডিও আকারে একক গান প্রকাশ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেটাও করতে পারছেন না।
সবচেয়ে ক্ষতির মুখে চলচ্চিত্রশিল্পের মানুষ। বিএফডিসিতে তো অনেকদিন আগে থেকেই ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। সেখানে আর কোনো শুটিং হয় না বললেই চলে। নির্বাচন কেন্দ্রিক পরিস্থিতির কারণে, নির্মিত সিনেমা মুক্তি পেছানো হচ্ছে বারবার। ঝুঁকি নিয়ে দু'একটা সিনেমা মুক্তি দেওয়া হলেও তা দর্শক খড়ায় ভুগছে।
জানা যায়, কুরবানির ঈদের পর এখন পর্যন্ত কোনো সিনেমা ব্যবসা করতে পারেনি। ভালো সিনেমার অভাবে এমনিতেই ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রেক্ষাগৃহগুলো। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সিনেমার মুক্তি বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। দু'একটা সিনেমা মুক্তি দেওয়া হলেও তা চলছে না। ফলে আসছে না নতুন সিনেমা, দর্শক খরায় প্রেক্ষাগৃহ। মহরত হওয়া বা আগাম শুটিংয়ের তারিখ নির্ধারিত হলেও বার বার তা পেছানোর কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন নির্মাতা-প্রযোজকসহ সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় কাজ কমে গেছে শিল্পীদের। বেকার হয়ে পড়েছেন নিয়মিত কাজ করা সংস্কৃতিকর্মীরা। ফলে বেকায়দায় পড়েছেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে 'শ্যামা কাব্য' সিনেমার মুক্তি স্থগিত করা হয়েছে। নভেম্বরের শুরুতে দেশে মুক্তি পায় সিনেমা 'অসম্ভব'। অভিনয়শিল্পী অরুণা বিশ্বাস পরিচালিত ও প্রযোজিত প্রথম সিনেমাটি বেশ আগ্রহ নিয়ে মুক্তি দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত হতাশ পরিচালক। তিন দিনের মাথায় সিনেমাটির দর্শকসংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। অরুণা বিশ্বাস বলেন, প্রথম পরিচালিত সিনেমাটি নিয়ে আমি খুবই হতাশ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ তো আসলে প্রেক্ষাগৃহে আসতে খুব ভয় পায়। মুক্তির আগে আভাস পাচ্ছিলাম, রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হবে। আবার এমনটাও ভেবেছিলাম, সবকিছুর স্বাভাবিক সমাধান হবে। কিন্তু হয়নি। এই পরিস্থিতিতে হলের মালিকরাও সাহস পাননি সিনেমা চালাতে। এখন তো যে অবস্থা, শাহরুখ খানের সিনেমা মুক্তি দিলেও চলবে না। এখন মনে হচ্ছে, সিনেমাটা নির্বাচনের পর মুক্তি দিলে ভালো হতো। 'যন্ত্রণা' নামের আরেক সিনেমা মুক্তি পেলেও ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়। দর্শক খড়ায় চলেনি সিনেমাটি। এদিকে ২৪ নভেম্বর মুক্তির কথা ছিল বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত সিনেমা 'শ্যামা কাব্য'। ঢাকার বিএফডিসিতে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তির তারিখ ঘোষণা করে ট্রেলার ও গান প্রকাশ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯ নভেম্বর রাতে পরিচালক সৌদ ফেসবুকে ঘোষণা দেন, সিনেমাটি মুক্তির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন তারা। পরিচালক সৌদ বলেন, আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে সুন্দর কোনো সময় দেখে সিনেমাটি মুক্তি দিতে চাই। এত কষ্ট করে বানানো সিনেমাটি এখন মুক্তি দেওয়া হলে তা সিনেমাপ্রেমীরা দেখার সুযোগ পাবেন না। তাই 'শ্যামা কাব্য' মুক্তির সিদ্ধান্ত স্থগিত করছি। পরিচালক সোয়াইবুর রহমান দীর্ঘ চার বছর আগে 'নন্দিনী' সিনেমার শুটিং করেন। বারবার জটিলতায় আটকে যায় শুটিং। চলতি বছর কাজ শেষ করে গত মাসে সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছিলেন। তার সিনেমাটি বিনা কর্তনে সেন্সর সনদও পেয়েছে। সেন্সর পেলেও নির্মাতার দুশ্চিন্তা কাটছে না। ফুয়াদ চৌধুরীর 'মেঘনা কন্যা' ১৭ নভেম্বর মুক্তির কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি সিনেমাটি। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশের কারণে প্রায় বেকার হয়ে পড়া শিল্পীরা বিপাকে পড়েছেন। তবে অচিরেই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।