শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা নাটক :'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ভালোবাসার দিবসের 'হৃদয়ে হৃদয়' নামের একটি নাটকের দৃশ্যে নিহা ও জোভান

'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'- কবি শঙ্খ ঘোষ রচিত এই পঙক্তিটি আজকালের রচনা নয়। পঞ্চাশ দশকের এই কবি নিশ্চয় এ অর্থে এই পঙক্তিটির রচনা করেন যেটা এখন টেলিভিশনে কোনো একটা প্রোগ্রাম চলাকালে কয়েক মিনিট পরপরই বেরসিকের মতো হাজির একের পর এক বিজ্ঞাপন। বিনোদন দূরের কথা চরম বিরক্তির কারণও হয়ে দাঁড়ায় এই বিজ্ঞাপনগুলো। আবার যারা এই বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলেন দর্শকদের তারাও যে এটা বোঝেন না এমন নয়। তাই দর্শক যাতে বিরক্তির শিকার না হন তাই তারাও একটা বিজ্ঞাপন খুব বেশি দিন প্রচার করেন না। সেটা যতই সুন্দর হোক। যতই জনপ্রিয় জিঙ্গেল থাকুক। দর্শককে দয়া করে তাই তারাও ঘন ঘন একটা বিজ্ঞাপনচিত্র নামিয়েই আরেকটা বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। বিলবোর্ডে যেমন দেখা যায় 'লা রেভ' এর মডেলে। এ রকম আরও বহু বিল বোর্ডে। অর্থাৎ দর্শক যতই বিরক্ত হোক তবুও তাদের একের পর এক বিজ্ঞাপন খাওয়াবেনই। এই ভোগান্তিই একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে টিভি দর্শকদের জন্য।

টেলিভিশন দর্শকদের এই অভিযোগ আজকালের নয়। এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এমনই এক অন্তরে রক্তক্ষরণ করা অতিষ্ঠকর যন্ত্রণা- যার শিকার থেকে কোনোভাবেই রেহাই না পাওয়াতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে টিভি নাটকে। তবে এমন নয় যে এই বিজ্ঞাপনের প্রচারের ইতিহাস আজকালের। আগে কখনো হতো না। আগেও হতো তবে তখন তা নাটকের ফাঁকে প্রচারিত হতো। কিন্তু এখন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নাটকের ফাঁকে নয়, দর্শক বিজ্ঞাপনের ফাঁকেই নাটক দেখছেন।

এখন যেসব নাটক নির্মাণ হচ্ছে এগুলো স্রেফ বিজ্ঞাপন প্রচারের অজুহাতেই? ফলে সেই বিজ্ঞাপনের উৎপাতে ঢেকে যাচ্ছে নাটকের চেহারাটিও। শিল্পের মধ্যে ব্যবসা ঢুকে পড়ায় নষ্ট করে দিচ্ছে নাটকের গুণগতমানও? নাটক নির্মাতারাও বুঝে গেছেন এমন উৎপীড়নকর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে সিরিয়াস নাটক কিছুতেই জমবে না। বারবার বেরসিক বিজ্ঞাপন এসে সেই সিরিয়াসনেস বেরসিকের মতো ভন্ডুল করে দেবে। তাই এখনকার নাটক নির্মাতারাও সেই আগের মতো আর সিরিয়াস নাটক বানাতে সাহস করছেন না। অথচ বর্তমানের যে রকম সময় যাচ্ছে তাতেই অনেক ভালো ভালো সিরিয়াস নাটক হতে পারে। যেটা আবার গুণগত মানের হিসেবে আগের সিরিয়াস নাটকের মানকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু তারা কেউই আর সাহস করছেন না বেরসিক বিজ্ঞাপন দাতাঅলাদের জন্য। বেরসিক বিজ্ঞাপন এজেন্সিদের জন্য। ফলে তার পরিবর্তে নাটকে নিয়ে আসছেন সেই ঘুরেফিরে একই রকমের যতসব উলস্নু আর ফানি বিষয়গুলোই। সেই দুই প্রাণীর একই সংলাপ আর একই কিচ্ছা-কাহিনীই।

আগে এক ঘণ্টার নাটকজুড়ে একবার থেকে বড়জোড় দুইবার বিজ্ঞাপন দেখানো হতো। আর তার ব্যাপ্তিকালও ছিল অতিসামান্য। আবার সেই বিজ্ঞাপনের স্ট্যান্ডার্ডও ছিল অনেক দারুণ। ফলে নাটকের সঙ্গে সেইসব বিজ্ঞাপন নিয়ে দর্শকের মনে কোনো বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াত না। এখন সেইসব দিন কবেই অতীত হয়ে গেছে। টিভি পর্দায় নাটকের সেই কদরও নেই আর। ড্রয়িংরুমের মানুষগুলোও যেন নিছক সময় কাটানোর জন্যই এগুলো দেখছে। আবার যখন বিজ্ঞাপনের প্রচার শুরু হয় তখনই আবার তারা ড্রয়িংরুম থেকে উঠে গিয়ে বেডরুমে চলে যাচ্ছে।

৪০ মিনিটের খন্ড নাটকে গোটা অর্ধেক সময়ই চলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপন প্রচারে। দর্শক নাটকের গল্প পান মাত্র ১৫-২০ মিনিট। এর মধ্যে নাটকের নাম, পরিচালক, অভিনয়শিল্পীদের পরিচিতি ও অন্যান্য তথ্য দেখানোয় চলে যায় খানিক সময়।

একইভাবে ধারাবাহিক নাটকের বেলায় প্রতি পর্বে নাটকের নাম-পরিচিতি ও প্রচারিত আগের ঘটনা সূত্র দেখানো শেষ হতে না হতেই টিভি পর্দায় চলে আসে প্রথম বিজ্ঞাপন। নাটকে ঢোকার আগেই বিজ্ঞাপনের এই যন্ত্রণা দর্শককে বিষিয়ে তোলে। এরপর আরও কয়েকবার বিজ্ঞাপন প্রচারের মধ্যে মূল নাটকের গল্প ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি পান না দর্শক। দর্শক দেখুক আর না দেখুক ধারাবাহিক একটি গল্প এগিয়ে নিলেও বিজ্ঞাপনের উৎপাতে হারিয়ে যাচ্ছে খন্ড নাটক। বিজ্ঞাপনের কারণে খন্ড নাটকের গল্প হয়ে যাচ্ছে সীমিত সময়ের। এই অল্প সময়ে ফুটে উঠছে না গল্পের সৌন্দর্য। অগোছাল, অস্পষ্টতায় পরিসমাপ্তি ঘটে একটি খন্ড নাটকের। পরে নতুন কোনো খন্ড নাটকের প্রতি আগ্রহ থাকে না দর্শকের। ফলে দিনকে দিন কমে যাচ্ছে টেলিভিশন নাটকের খন্ড নাটক। বিশেষ কোনো দিন কিংবা বিশেষ উৎসবেই একক নাটক নিয়ে মাতামাতি থাকলেও বছরের বাকি সময়ের অবস্থা খুবই খারাপ।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একক নাটক আর কিছুদিন পর হয়তো শূন্যের কোটায় চলে আসবে। তবে দেশে টিভি চ্যানেল বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়েনি টিভি নাটকের মান ও সৌন্দর্য। দর্শক যেন দুটো তরুণ তরুণী দেখতেই টিভি সেটের সামনে বসে আর কিছুর জন্য নয়। খন্ড নাটক দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হলেও চ্যানেলগুলো যেন ধারাবাহিক নাটক প্রচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

নাট্যসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিজ্ঞাপনদাতা ও চ্যানেলগুলোর অনীহার কারণে এক ঘণ্টার নাটক নির্মাণ কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতারা মনে করেন এক ঘণ্টার নাটকের চেয়ে ধারাবাহিক নাটকে বিনিয়োগ করলে পণ্যের প্রচার বেশি হবে। ধারাবাহিক নাটক তো সপ্তাহে ২-৩ দিন প্রচারিত হয়, অন্যদিকে এক ঘণ্টার নাটকের প্রচার এক দিন এবং এক ঘণ্টাতেই শেষ। এসব কিছু বিবেচনা করে তারা এক ঘণ্টার নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, 'চ্যানেলগুলোতে দিন দিন এক ঘণ্টার নাটক দেখানো কেন জানি কমে যাচ্ছে। আমি নিজেও খন্ড নাটকের একজন ভক্ত। এসব নাটকে যে উত্তেজনাটুকু পাওয়া যায় ধারাবাহিকে তা পাওয়া যায় না। চ্যানেলগুলো যদি বিজ্ঞাপন কমিয়ে এক ঘণ্টার নাটক প্রচারে আরও গুরুত্ব দেন তাহলে দর্শকরা নাটকের মাধ্যমে আবারও বিনোদন খুঁজে পাবেন।'

মামুনুর রশীদ বলেন, 'নাটক এখন সম্পূর্ণভাবে মার্কেটিং ও পুঁজিবাদীদের হাতে চলে গেছে। বিজ্ঞাপন থাকবে তবে তা মাত্রারিক্ত নয়। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের কারণে দর্শক টেলিভিশনের সামনে বসে নাটক দেখতে চান না। এখন মানুষের হাতে অনেক মাধ্যম হয়েছে নাটক দেখার। সেভাবে নাটক দেখে।'

টেলিভিশন চ্যানেলে বাইরে ইউটিউবের জন্য নির্মিত হচ্ছে অনেক খন্ড নাটক। টেলিভিশন চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের যন্ত্র থেকে রেহাই পেতে দর্শক এখন খন্ড নাটক দেখেন ইউটিউবে। এই মাধ্যমে যে বিজ্ঞাপন নেই তা নয়, তবে এখানে অতি অল্প সময়ে একটি বিজ্ঞাপনের প্রচার হয়। দর্শকের মনোযোগ নষ্ট হয় না নাটক থেকে। যেটি টিভি চ্যানেলে দুরাশা মাত্র। তাদের কথা হচ্ছে নাটক কি দেখবে, অভিনয় কি দেখবে দেখ আমাদের প্রচারিত বিজ্ঞপনের হই-হলস্না. চেঁচামেচি আর দুজনের এলেবেলে উলস্নু ও ফানি কথামালা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে