বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

নামকরণের বৈচিত্র্যে বাংলা সিনেমা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আব্দুস সামাদ খোকন পরিচালিত 'শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়'র সিনেমার একটি দৃশ্যে গাজী আব্দুন নূর এবং প্রার্থনা ফারদিন দিঘী

সিনেমা হলো এমন এক মাধ্যম যেখানে একটি জনসমাজ বা জাতির দর্পণ প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সিনেমার মধ্য দিয়েই প্রকাশ ঘটে সে জনজীবন, সমাজ, সংস্কৃতির ধরন কীরকম। কোনো দেশের সঙ্গে কেমন পার্থক্যও ধরা পড়ে তাতে। নিশ্চয় ইরানের সিনেমার সঙ্গে বাংলাদেশের সিনেমার কোনো মিল থাকবে না।

আর তখন এই দর্পণটি যদি সিনেমার নামেই হয় তখন সহজেই বুঝা যায় সিনেমাটি কি বলতে চাচ্ছে। কেমন হতে পারে সে ছবির গল্প। কারণ সিনেমার নামকরণেও একটি জাতির সমাজ ও সংস্কৃতির ভৌগোলিক পরিচয় পাওয়া যায়। নামকরণেও বুঝা যায় ওই সমকালীন ভৌগোলিক জীবনব্যবস্থা কেমন ছিল। জীবনের মান কেমন ছিল। মানুষের রুচিবোধ কেমন ছিল। পাশাপাশি এই নামকরণে মানুষের রুচির পরিবর্তনের দিকগুলোও বুঝা যায়। তাহলে সিনেমা যদি হয় একটি জাতির দর্পণ, সেক্ষেত্রে সিনেমার 'নাম' হচ্ছে সেই সিনেমাটির দর্পণ। এখন এই দর্পণটি কেমন হবে সেটাও রুচির বিষয়। বৈশ্বিক সিনেমার পাশাপাশি এরকমভাবে রুচির পালাবদলের সঙ্গে নামের পরিবর্তন হয়ে আসছে বাংলা সিনেমায়ও।

বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিনেমা 'মুখ ও মুখোশ'। যা বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসেরই অংশ হয়ে আছে। প্রথম বাংলা সিনেমার নামকরণেই ছিল একটি প্রতীকী দর্পণ। 'মুখ' তো দর্পণই। আর সেই মুখ যদি 'মুখোশে' ঢাকা থাকে? এ থেকেও সহজেই বোঝা যায়, একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের রূপরেখা কেমন ছিল তার দিকদর্শনই ফুটে আছে এই 'মুখ ও মুখোশে'। এই সিনেমার পর ৮ মে, ১৯৫৯ সালে প্রকাশ পায় আখতার জং কারদার পরিচালিত 'জাগো হুয়া সাভেরা' নাট্যধর্মী সিনেমাটি। সফল এই সিনেমাটির পর থেকেই ঢালিউড সিনেমায় একের পর এক কাব্যিক নাম ব্যবহৃত হতে থাকে। যেমন- ফতেহ লোহানী পরিচালিত 'আকাশ আর মাটি', মহিউদ্দিন পরিচালিত 'মাটির পাহাড়', এহতেশাম পরিচালিত 'এ দেশ তোমার আমার' 'রাজধানীর বুকে', ফতেহ লোহানী পরিচালিত 'আসিয়া'। এই চলচ্চিত্রটি সে সময়ে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে।

ওই সময়ে আরও অনেক সিনেমা আছে, যেগুলোর নামেই বোঝা যায় তখন সিনেমার দর্শক কারা ছিলেন। তারা ছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ। যাদের জীবন ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ছিল নদীমাতৃক অর্থনীতির সঙ্গে লোকসংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্য। এই একই সমাজভুক্ত ছিলেন সিনেমা নির্মাতারাও।

নামেই শুধু নয়- একটা সিনেমা কতটা ভালো ছিল সেই সিনেমার গানেও তার প্রমাণ মিলত। সিনেমার গানগুলোর সবই ছিল কাব্যিক। এক পেস্ন-ব্যাকের মধ্য দিয়েই বহু গায়ক-গায়িকা স্মারণীয় হয়ে আছেন। অনেক সিনেমার নামও হয়েছে স্মারণীয় সব গানের টাইটেলে। যেমন- 'নীল আকাশের নিচে' 'দিন যায় কথা থাকে' প্রভৃতি। যারা কণ্ঠ দিয়েছেন প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো গান মানুষের লোকমুখে শোনা যেত। গানের সুরের মতোই যেন ছিল সিনেমার নামগুলোও। মানুষের অবসরের আড্ডায় এই সিনেমার নামগুলো বারবার উঠে আসত। কারণ নামগুলোর মধ্যেও পরিচয় ঘটত তার গল্পের। তারপরই সিনেমার কাহিনির কথা খৈ ভাজার মতো ফুটত। গল্প ও গল্পের নামের সঙ্গে নিবিড় প্রাণের যোগ ছিল ষাট-সত্তরের নাম সিনেমা। যেমন- 'যে নদী মরুপথে' (সালাহউদ্দিন), 'হারানো দিন' (মুস্তাফিজ), 'তোমার আমার' (মহিউদ্দিন), 'কখনো আসেনি' (জহির রায়হান), সূর্যস্নান (সালাহউদ্দিন), 'সোনার কাজল' (জহির রায়হান ও কলিম শরাফী), 'জোয়ার এলো' (আব্দুল জব্বার খান), 'নতুন সুর' (এহতেশাম), 'কাঁচের দেয়াল' (জহির রায়হান)।

স্বাধীনতাপূর্বের সব সিনেমার নামেই সমকালীন নগরজীবনের পাশাপাশি গোটা বাঙালির পরিবার, সমাজ, জীবন-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, জীবন-দর্শন ও তার রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন- কলিম শরাফী ও জহির রায়হানের 'সোনার কাজল' আব্দুল জব্বারের 'জোয়ার এলো'। তবে ১৯৬৩ সালের পর থেকে কাব্যিক ও শ্রম্নতিমধুর নামের পাশাপাশি রূপক বা প্রতীকী অর্থের নামও যুক্ত হয়। যেমন- 'শাদী', 'সঙ্গম', 'মিলন' প্রভৃতি।

শুধু মধ্যবিত্ত সমাজের পরিচয় বহন করে এমন কাব্যিক ও শ্রম্নতিমধুর নামের সিনেমা আর একচেটিয়া থাকেনি। ইবনে মিজানের 'একালের রূপকথা'র পর থেকে এলো সেকালের রূপকথা নির্ভর লোক কাহিনি-ঘেঁষা নাম। সালাহউদ্দীনের 'রূপবান' হয়ে একে একে 'রহিম বাদশাহ ও রূপবান' (সফদর আলী ভূঁইয়া), 'আবার বনবাসে রূপবান' (ইবনে মিজান), 'রাজা সন্নাসী' (খান আতাউর রহমান), 'গুনাই বিবি' (সৈয়দ আউয়াল), 'গুনাই' (বজলুর রহমান), 'ভাওয়াল সন্নাসী' (রওনক চৌধুরী), মহুয়া (আলী মনসুর), বেহুলা (জহির রায়হান), 'ময়ূরপঙ্খী' (হাবিব মেহেদী), হীরামন (রাশেদ আজগর চৌধুরী), 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা (খান আতাউর রহমান), 'সাইফুলমুলক বদিউজ্জামাল' (আজিজুর রহমান), 'আলীবাবা' (নজরুল ইসলাম), 'জুলেখা' (আমজাদ হোসেন), 'মধুমালা' (আজিজুর রহমান), 'সাত ভাই চম্পা' (দিলীপ সোম), 'সুয়োরানী দুয়োরানী' (রহিম নেওয়াজ), 'কুচবরণ কন্যা' (নুরুল হক বাচ্চু), 'অরুণ বরুণ কিরণমালা' (খান আতাউর রহমান), 'চম্পা কলি' (সফদর আলী ভূঁইয়া), 'রূপবানের রূপকথা' (ই. আর. খান মামা), 'গাজী কালু চম্পাবতী' (মহিউদ্দিন), 'পাতালপুরীর রাজকন্যা' (ইবনে মিজান), 'আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী' (ইবনে মিজান), 'বেদের মেয়ে' (নুরুল হক), 'মলুয়া' (ফাল্গুনী গোষ্ঠী) প্রভৃতি। পাশাপাশি মধ্যবিত্তের পরিচয়মূলক নামও অব্যাহত থাকে। যেমন- '১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন' (বশীর হোসেন), 'কাগজের নৌকা' (সুভাষ দত্ত), 'জোয়ার ভাটা' (খান আতাউর রহমান), 'মায়ার সংসার' (মোস্তফা মেহমুদ), 'স্বর্ণকমল' (নজরুল ইসলাম) 'সোয়ে নদীয়া জাগে পানি' (খান আতাউর রহমান) 'পদ্মা নদীর মাঝি' (আলমগীর কুমকুম), 'নীল আকাশের নিচে' (নারায়ণ ঘোষ মিতা), 'যে আগুনে পুড়ি' (আমির হোসেন), 'সূর্য ওঠার আগে' (নাজমুল হুদা পিন্টু), 'মিশর কুমারী' (কারিগর), 'পিচঢালা পথ' (এহতেশাম), 'ঢেউয়ের পরে ঢেউ' (মহসীন), 'কাঁচকাটা হীরে' (আব্দুল জব্বার খান), 'দ্বীপ নেভে নাই' (নারায়ণ ঘোষ মিতা), 'নাচের পুতুল' (অশোক ঘোষ), 'জলছবি' (এইচ আকবর), 'গায়ের বধূ' (আব্দুল জব্বার খান/আলী কায়সার)সহ আরও অনেক শ্রম্নতিমধুর কাব্যিক নাম।

এরপর সত্তরের মাঝামাঝিতে লোক কাহিনিভিত্তিক সিনেমা অতিলৌকিকতায় মোড় নেয়। আসে পোশাকি-ফ্যান্টাসি ধর্মী সিনেমার জোয়ার। ষাটের লোক কাহিনি নির্ভর সিনেমা কী রকম জনপ্রিয় ছিল সত্তর-আশির দশকেও। এ সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়াও লাগে ফোক-ফ্যান্টাসিমূলক সিনেমায়। স্বাধীনতার পরে এই নাম পরিচয়ে যোগ হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে