সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শাফিন সমাহিত হবেন বনানী কবরস্থানে

বিনোদন রিপোর্ট
  ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শাফিন সমাহিত হবেন বনানী কবরস্থানে
শাফিন সমাহিত হবেন বনানী কবরস্থানে

কনসার্টে অংশ নিতে চলতি মাসের ৯ তারিখ যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ। ২০ জুলাই ছিল সেই কনসার্ট, কিন্তু তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন শিল্পী। ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৬টার দিকে প্রয়াণ ঘটে বহু কালজয়ী গানের এই শিল্পীর। এরপর থেকে শাফিনের মরদেহ দেশে আনার প্রস্তুতি শুরু হয়। মরদেহ দেশে আনতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথাও ছিল বড় ভাই হামিন আহমেদের; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। গত শনিবার বিকালে হামিন গণমাধ্যমে জানান, ২৯ জুলাই বিকালে শাফিনের মরদেহ ঢাকায় পৌঁছাবে। হামিন আরও জানান, শাফিনের মরদেহ বহনকারী উড়োজাহাজ ২৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে।

শাফিন আহমেদের ছেলে আযরাফ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'বাবার প্রথম জানাজা যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাকে আনতে মা সেখানে গেছেন। আজই রওনা হওয়ার কথা।'

1

ভার্জিনিয়ার দার আল নুর ইসলামিক কমিউনিটি মসজিদে গত শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় তার প্রথম জানাজা হয়। সেখানে প্রায় দুই হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল বলে জানিয়েছেন শিল্পীর ছেলে আযরাফ রাকিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'বাবার প্রথম জানাজা হয়েছে ভার্জিনিয়ার দার আল নুর মসজিদে। প্রায় দুই হাজার মানুষের উপস্থিতি ছিল।' জানাজার পর শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান স্থানীয় বাঙালিরা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শাফিন আহমেদের স্ত্রী ডা. রুমানা দৌলা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে শাফিন আহমেদের পরিবার।

এবার মাতৃভূমিতে ফেরার পালা, 'তুলনাহীন' তারকা শাফিন আহমেদের মরদেহ। ইতোমধ্যে শিল্পীর মরদেহ দেশে আনার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে পরিবার। আগামী (৩০ জুলাই) মঙ্গলবার দ্বিতীয় জানাজা হবে ঢাকায় গুলশান আজাদ মসজিদে বাদ জোহর। এরপর বনানী কবরস্থানে বাবার কবরে সমাহিত করা হবে শাফিনকে। বিষয়টি জানিয়েছে ব্যান্ডদল মাইলস।

তার এই অকাল প্রস্থানে রেখে গেছেন দুই বড় ভাই তাহসিন ও হামিন, স্ত্রী ডা. রুমানা দৌলা, তিন পুত্র মাইসিম, আজরাফ ও রেহান এবং এক কন্যা রানিয়াকে। সঙ্গে অগুনতি ভক্ত-বন্ধু-স্বজন।

দীর্ঘদিন ধরে হার্টের অসুখে ভুগছিলেন শাফিন আহমেদ। শাফিন আহমেদের মৃতু্যতে শোকাহত সঙ্গীতাঙ্গন। শোকবার্তা জানিয়েছেন বিভিন্ন স্তরের সাংস্কৃতিক কর্মী। রেনেসাঁ ব্যান্ডের শিল্পী, গীতিকার, সুরকার নকীব খান বলেন, 'শাফিন আহমেদের মৃতু্য দেশের ব্যান্ড মিউজিক ও ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক বিরাট ক্ষতি।' তিনি বলেন, 'সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে এরকম একটা খবর পাব কখনো কল্পনাও করিনি। আমরা কখনো শুনিনি শাফিন অসুস্থ। আমাদের জন্য তার মৃতু্যর খবর মেনে নেওয়া কঠিন। কিছু বলার ভাষা নেই, ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।'

আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের সোনালি সময়ের কথা স্মরণ করে রেনেসাঁর এই শিল্পী বলেন, 'শাফিনের অনেক কনট্রিবিউশন আছে ব্যান্ড মিউজিকে। সে নিজে গান লিখত, সুর করত, নিজেই গাইত। সে খুব ভালো একজন মিউজিশিয়ান ছিল। ভালো গিটার বাজানো থেকে শুরু করে সে নিজেই একটা ব্যান্ড ছিল। আমাদের মাঝ থেকে এ ধরনের প্রতিভা চলে যাওয়া এটা আসলে ভাবতে পারছি না। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।'

প্রথম শোনায় খবরটি বিশ্বাস হয়নি ফিডব্যাক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সঙ্গীত পরিচালক ফোয়াদ নাসের বাবুর। তিনি বলেন, 'সকাল সকাল এমন একটা খবর পাব, যেটা খুবই মর্মাহত করেছে আমাদের। প্রথম শোনায় বিশ্বাস হয়নি, এখনো মনে হচ্ছে খবরটা হয়তো ভুল হতে পারে। শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়েছিল তার গান। তার আকস্মিক মৃতু্যতে ভীষণ শোকাহত।'

সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক শওকত আলী ইমন বলেন, 'শাফিন ভাই একজন মিউজিক লিজেন্ড ছিলেন। উনার যে ক্রিয়েশন, মাইলসের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। শেষের দিকে উনি মাইলস ছেড়ে দিয়েছেন। একজন ভক্ত হিসাবে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। উনি উনার সঙ্গীত ক্যারিয়ারে মাত্র একটি গান করেছেন সিনেমায়। সেটা আমার করা। কবির বকুলের লেখায় গানটির শিরোনাম ছিল 'পাগলের মতো ভালোবাসি তোমায়'। সিনেমাটি নাম ছিল 'ওয়ার্নিং'। আমার সঙ্গে শাফিন ভাইয়ের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি সিনেমায় গান করতেন না, এ গানটি গেয়েই আমাকে বললেন, 'ইমন তোর জন্য গাইলাম'। আমার সঙ্গে প্রায় সময় উনি সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করতেন। উনি চলে যাওয়াতে সঙ্গীতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।'

গীতিকার কবির বকুল বলেন, 'শাফিনের জন্ম ভালোবাসা দিবসে। সব সময় আমাদের ভালোবাসা দিয়েই ভরিয়ে দিয়েছে। ওর সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। আমি আজকেই (গতকাল) নিউ ইয়ার্ক থেকে এলাম। যদি থাকতাম তাহলে ওর সঙ্গে দেখা হতো। ওর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। আমার লেখা একটি গান গেয়েছে সিনেমায়। এটিই তার জীবনে প্রথম ও শেষ গান ছিল সিনেমার জন্য। অনেক ভালো একজন মানুষ ছিল। সব সময় সবার খবরাখবর রাখত। এখন তো চলেই গেছে আমাদের ছেড়ে। শুধু এটাই বলব, যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।'

সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পা মাজুমদার বলেন, 'সকাল থেকে খবরটি শুনে আমার মাথায় কোনো কিছু কাজ করছে না। বিশ্বাসই হচ্ছে না উনি আর নেই ! কী বলব আর, বলার মতো কিছু নেই। উনি এতটা কাছের ছিলেন যে, এখনো উনার মৃতু্যর খবর আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মৃতু্যকে মেনে নিতেই হয়। তবু কিছু মৃতু্য আমাদের মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়। আমি এই মুহূর্তে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আমি এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি।' সঙ্গীতশিল্পী নাজমুন মুনিরা ন্যান্‌সি বলেন, 'আমরা তো এই কদিন ধরে মৃতু্যই দেখছি। ১৬/১৮ বছরের ছেলেদের মেরে ফেলা হয়েছে। এগুলো আমরা দেখেছি। শাফিন ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, অবশ্যই এটা খারাপ লাগার। কিন্তু দেশের মধ্যে যে মৃতু্যর ঘটনা দেখেছি তাতে আর কিছু বলার নেই। আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন কোন অবস্থার মধ্যে আমরা আছি।'

সঙ্গীতশিল্পী হৃদয় খান, 'আমি একটা কাজে খুব ব্যস্ত আছি। তাই খবর দেখা হয়নি। আমি আপনার কাছে (প্রতিবেদক) এ মুহূর্তে খবরটা শুনেছি। আমি খুবই শক্‌ড। উনার এ রকম মৃতু্য মানতেই পারছি না। খুব হতবাক আমি। আমার কথা বলার মতো কিছু নেই।' সঙ্গীত শিল্পী দিলশাদ নাহার কণা বলেন, 'শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। কিছুদিন আগেও আমি একটা গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, সেখানে শাফিন ভাইয়ের ছেলেও আমার সঙ্গে ছিল। উনি বিদেশে একটি শো করতে গেছেন সেটা জানতাম। কিন্তু মৃতু্যর খবর শুনতে হবে সেটার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। আমি খবরটি শুনে খুবই শকড। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আলস্নাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুক।'

বাংলাদেশের সঙ্গীত অঙ্গনের দুই মহারথী সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম এবং সুরকার কমল দাশগুপ্তের ছেলে শাফিন নিজে ছিলেন বেইজ গিটারিস্ট, সুরকার এবং গায়ক। ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি তার জন্ম। বড় ভাই হামিন আহমেদসহ ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে পশ্চিমের সঙ্গীতের সঙ্গে সখ্য হয় শাফিনের। শুরু হয় তার ব্যান্ড সঙ্গীতের যাত্রা।

ফরিদ রশিদের হাত ধরে ১৯৭৯ সালে তারা গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল 'মাইলস'। প্রথম কয়েক বছর তারা বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলে ইংরেজি গান গাইতেন। এরমধ্যেই প্রকাশিত হয় দু'টি ইংরেজি গানের অ্যালবাম 'মাইলস' ও 'এ স্টেপ ফারদার'। পরে মাইলসের বাংলা গানের প্রথম অ্যালবাম 'প্রতিশ্রম্নতি' বের হয় ১৯৯১ সালে।

মাইলসের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'চাঁদ তারা সূর্য', 'প্রথম প্রেমের মতো', 'গুঞ্জন শুনি', 'সে কোন দরদিয়া', 'ফিরিয়ে দাও', 'ধিকি ধিকি', 'পাহাড়ি মেয়ে', 'নীলা', 'কি যাদু', 'কতকাল খুঁজব তোমায়', 'হৃদয়হীনা', 'স্বপ্নভঙ্গ', 'জ্বালা জ্বালা', 'শেষ ঠিকানা', 'পিয়াসী মন', 'বলব না তোমাকে', 'জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় লাইন' ও 'প্রিয়তমা মেঘ'।

ছোটবেলা থেকেই শাফিন আহমেদ গানের ভেতরেই বড় হন। বাবার কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখেছেন আর মার কাছে নজরুলগীতি। এরপর তো প্রথমে ইংরেজি পরে বাংলা ভাষায় ব্যান্ডসঙ্গীত গেয়ে এই যুগান্তকারী ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলেন 'মাইলস' এর মধ্যদিয়ে। যা বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদিও গেল কয়েক বছর দুই ভাইয়ের আর্থিক বিবাদে মাইলস ছেড়ে নতুন দল গড়েন শাফিন। নাম রাখেন 'ভয়েস অব মাইলস'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে