আপাদমস্তক নায়ক বলতে যা বুঝায় তাই তিনি। সুপুরুষের মতো দৈহিক গঠন, সুশ্রী চেহারা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, মন হরণ করা হাসি, পরিমিত উচ্চারণ ও বাচন ভঙ্গি সবই আছে তার মধ্যে। বলছি, ঢাকাই ছবির এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা। পর্দায় একাধারে তিনি রোমান্টিক, অ্যাকশন বয়, কমেডিয়ান এবং পরিবারের সুবোধ বালক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তার সব উপস্থিতিই লুফে নিয়েছে দর্শকরা। বিশেষ করে পারিবারিক টানপড়েনে বিদ্ধ সংগ্রামী পুরুষ চরিত্রের ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয় আজও নন্দিত হয় পথে প্রান্তরে। এসব চরিত্রে কাজ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সিনেমার সুপারস্টার।
ভাইবোনের কাছে ভাই, ভাবির কাছে দুষ্টু মিষ্টি দেবর, বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান আর প্রেমিকা তার চরিত্রের প্রেমে পড়তেন অবলীলায়। আজ এই চিরসবুজ নায়কের জন্মদিন। বাংলা চলচ্চিত্রে সোনালি যুগের অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জের আশুতিয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হাজী আব্দুল আলী, মাতার নাম সরুফা খাতুন।
ইলিয়াস কাঞ্চন ১৯৭৫ সালে কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। কৈশোর থেকেই অভিনয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল ইলিয়াস কাঞ্চনের। তাই যুক্ত হয়েছিলেন বেশ কিছু নাট্য সংগঠনের সঙ্গে। নানা পথ পেরিয়ে অবশেষে কিংবদন্তি নির্মাতা সুভাষ দত্তের 'বসুন্ধরা' ছবি দিয়ে ১৯৭৭ সালে এ দেশীয় চলচ্চিত্রে ববিতার নায়ক হয়ে আবির্ভাব ঘটে ইলিয়াস কাঞ্চনের। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি এ অভিনেতার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তির পথে নিয়ে গেছেন। এ পর্যন্ত অভিনয় করেছেন ৩শ'রও বেশি সিনেমায়। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। আর ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া তার অভিনীত 'বেদের মেয়ে জোছনা'র ব্যবসায়িক সাফল্য এখনো ঢাকাই ছবিতে রূপকথা হয়ে আছে।
তোজাম্মেল হক বকুলের পরিচালনায় এই ছবিতে কাঞ্চন জুটি বেঁধেছিলেন অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে। সীমাহীন কষ্টের এক অসাধারণ প্রেমের গল্প বেদের মেয়ে জোছনা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বাধিক ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। ছবিটির সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পুননির্মাণ করে মুক্তি দেওয়া হয়। সেখানে মূল ভূমিকায় অভিনয় করেন অঞ্জু ঘোষ এবং চিরঞ্জীত। এছাড়া, ভেজাচোখ ছবিতে তার দুর্দান্ত অভিনয় কাঁদিয়েছিল প্রতিটি দর্শককেই।
দীর্ঘদিনের অভিনয় জীবনে ইলিয়াস কাঞ্চন উপহার দিয়েছেন বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় জুটি। অঞ্জু ঘোষের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে দিতি, চম্পাকেও তার সঙ্গে জুটি করে সফলতা পেয়েছেন নির্মাতারা। এছাড়াও অভিনয় করেছেন রোজিনা, কবিতা, সুচরিতা, সুনেত্রা, শিল্পী, মৌসুমী, পপিসহ অনেক নায়িকার বিপরীতে।
বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক জনপ্রিয় গানের কথা মনে হলেও ভেসে উঠে ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা। যার মধ্যে উলেস্নখ করা যায়- 'আমার গরুর গাড়ীতে বউ সাজিয়ে', 'কথা বলবো না, বলেছি', 'আজ রাত সারারাত জেগে থাকবো', 'সত্য কি? মিথ্যে কি'?', 'পৃথিবীর যত সুখ' 'জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প', 'তুই তো কাল চলে যাবি', 'প্রিয়া আমার প্রিয়া', 'তুমি চেনো কি আমারে', 'আমরা বাপবেটা ৪২০', 'আর যাবো না আমেরিকা', 'আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা', 'বেলি ফুলের মালা দিয়ে', 'আমি আজ কথা দিলাম আই লাভ ইউ', 'ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়', 'আমার এ গান তোমারই জন্য', 'আমরা দুজন চিরসাথী', 'সবার জীবনে প্রেম আসে' গানের নাম।
ইলিয়াস কাঞ্চন প্রযোজক হিসেবেও সফল। তিনি যৌথভাবে প্রথম প্রযোজনা করেন 'সর্পরানী' ও 'বোনের মতো বোন' চলচ্চিত্র। এরপর তিনি এককভাবে প্রযোজনা করেন 'বাদশা ভাই', ক্যারিয়ারের ১০০তম চলচ্চিত্র 'মাটির কসম', 'খুনী আসামী',' বদসূরত', 'বাঁচার লড়াই',' মুন্না মাস্তান' ইত্যাদি।
পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নানারকম সামাজিক আন্দোলনে রেখে চলেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য স্ত্রীর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর পর থেকে 'নিরাপদ সড়ক নিরাপদ জীবন' স্স্নোগানে আন্দোলন। তার বদৌলতেই 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনটি বর্তমান বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে এবং এর সঙ্গে বিভিন্ন মহল একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তিনি বর্তমানে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রধান কান্ডারি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। আর সমাজসেবায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেন।