শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতেও 'সক্রিয়' কিশোর গ্যাং

এলাকার গন্ডি পেরিয়ে নির্বাচনী সহিংসতায়ও তাদের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে হ গ্রাম পর্যায়ে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং কালচার
গাফফার খান চৌধুরী
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১৯

এলাকাভিত্তিক প্রভাব বিস্তারের গন্ডি পেরিয়ে কিশোর গ্যাং এখন রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে কিশোর গ্যাং সদস্যদের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা গেছে। সারাদেশে অনুষ্ঠিত পাঁচ শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রাণহানি হয়েছে ২৬ জনের এবং আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ১০ হাজার কিশোরের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকাতে ভবিষ্যতে ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনেও ভোট কেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে। নির্বাচনী সহিংসতা কমিয়ে আনতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা তুলনামূলক বেশি ঘটছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় কিশোদের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। সারাদেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটি নির্বাচনী সহিংসতায় উঠতি বয়সি তরুণ বা কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান যায়যায়দিনকে জানান, এমন অভিযোগ তারাও পেয়েছেন। নির্বাচনকে ঘিরে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। কিশোররা কিভাবে জড়িয়ে পড়েছে এবং কাদের প্ররোচনায় জড়িয়ে পড়েছে বা তাদের সংখ্যা কেমন তা জানার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের তরফ থেকে জেলা পুলিশ সুপারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক ডক্টর বেনজীর আহমেদ। নির্বাচন বা অন্য যেকোনো ধরনের সহিংসতা কমিয়ে আনতে ভবিষ্যতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও ভোট কেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে জানান, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় কিশোর বা উঠতি বয়সিদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে। তাদের কারা কিভাবে প্ররোচিত করে সহিংসতায় জড়িয়েছে তা জানতে আমাদের গোয়েন্দা সদস্যরা কাজ করছেন। নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা এবারের নির্বাচন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। এবারের নির্বাচনী সহিংসতার প্যাটার্ন একটু ভিন্ন। আগে দেখা যেত গোষ্ঠী গোষ্ঠী বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতো। এবারের নির্বাচনে সেটি একেবারেই নেই। কারণ এবারের নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। তাই সংঘর্ষ বা মারামারি যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের গা বাঁচাতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। তারা উঠতি বয়সি তরুণ বা কিশোরদের সহিংসতায় জড়িয়েছেন। যা খুবই দুঃখজনক ও হতাশার কথা। যেসব কিশোর সহিংসতায় জড়িয়েছে, তারা না জেনেশুনেই অনেকটা ঝুঁকের মাথায় করেছে। তরুণ ও কিশোরদের সহিংসতায় বেশি ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ্য করে গেছে স্থানীয় পর্যায়ে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের মধ্যে। তারা ক্ষমতা হারাতে চাননি। তাই তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর ও উঠতি বয়সি তরুণদের ব্যবহার করেছেন। তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচনে উঠতি বয়সি তরুণ ও কিশোরদের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। গ্রাম পর্যায়ে কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠছে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকারের এখনই উচিত এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে গ্রাম পর্যায়ে কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠছে। প্রযুক্তিগত অপরাধ বাড়বে। কারণ এখন গ্রাম পর্যায়েও ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। কিশোর গ্যাং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য রীতিমতো হুমকি স্বরূপ। কারণ আজকের ছোট ছোট অপরাধ করা কিশোরই এক সময় বড় অপরাধী হয়ে ওঠতে পারে। যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি হওয়াও বিচিত্র নয়। কিশোর গ্যাং কালচার সম্পর্কে খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর জিয়া রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক কারণে এবং ইন্টারনেটের অপব্যবহারের সূত্রধরেই মূলত কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠে। যেটি এখন গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়ে গেছে। এছাড়া শিক্ষাগত কিছু কারণও আছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় নিম্নআয়ের পরিবারের কিশোররা নানা কারণে শিক্ষা থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। আবার স্কুল থেকেই ঝরে পড়ে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে এসব কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়। প্রথম প্রথম এসব কিশোররা হতাশা ভুলে থাকতে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর মাদক সেবনকালে স্বাভাবিক কারণেই সমবয়সি কিশোরদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক হয়। এরপর তারা নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছে গ্যাং। এরা মাদকের টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই, মাদক বিক্রি, সহিংসতাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। তিনি আরও বলেন, নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ পিতামাতাই টাকা রোজগারের দিকে বেশি মনোযোগী হন। তারা সন্তানদের তেমন সময় দিতে পারেন না। এমন সুযোগে আস্তে আস্তে সন্তানরা সঠিক পথ থেকে ছিটকে পড়ে। এটি একটি সামাজিক সমস্যা। সামাজিকভাবে কোথাও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা দেখা গেলে, সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এতে করে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমে যাবে। যদিও বিচার ব্যবস্থায় কিশোর অপরাধীদের উপযুক্ত সাজা দেওয়া হচ্ছে। যা ইতিবাচক। আর পুলিশের তরফ থেকে সারাদেশেই কিশোর গ্যাং কালচারের বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটিও সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। সঠিকভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হলে দেখা যাবে, ভবিষ্যতে আর কোনো কিশোর সহিংসতায় জড়াবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে