শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতিতে ফের ইতিবাচক হাওয়া

রপ্তানি আয় ও প্রবাসী রেমিট্যান্স বৃদ্ধি হ ব্যাংকে নগদ টাকা ও ডলার সংকট কমছে হ বাড়ছে রিজার্ভ ও বিদেশি বিনিয়োগ হ দাতাসংস্থার ঋণ প্রতিশ্রম্নতি বেড়েছে
পবন আহমেদ
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

নতুন বছরের শুরুতেই দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। দেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে সূচকের কিছু উন্নতি হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থনীতির প্রধান তিন সূচকে সুখবর মিলেছে। সেই সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে রিজার্ভও। ব্যাংকের নগদ টাকা ও ডলার সংকট কমতে শুরু করেছে। রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পে দাতা সংস্থার ঋণ প্রতিশ্রম্নতি বেড়েছে। এছাড়া ডিসেম্বর মাসে রপ্তানি আয় রেকর্ড পরিমাণ। বেড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমেছে। শুধু তাই নয়, কমতে শুরু করেছে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন, এটা দেখে সার্বিক অর্থনীতি বিবেচনা করাটা ঠিক হবে না। ফলে অর্থনীতিতে কোনো স্বস্তির বাতাস আশা করা যায় না। তাই মন্দা মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সব পর্যায়ে।

এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে মন্দার আতঙ্ক। যা থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মন্দা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সর্বশেষ সোমবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টালিনা জর্জিভাও এক অনুষ্ঠানে আগের সেই কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, 'চলতি বছর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মন্দাকবলিত হবে।'

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল যায়যায়দিনকে বলেন, বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে দেশে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ইতিবাচক। তবে এ ধারা ধরে রাখতে হলে সরকারকে এ খাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। সচল রাখতে হবে বিদু্যৎ ও গ্যাস সরবরাহ। সামনের দিনগুলো দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন সময় পার করতে হবে। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতিই যেহেতু টালমাটাল রয়েছে, তাই এখনই সবকিছু বলা যাচ্ছে না। তবে নতুন করে করোনাভাইরাস বৃদ্ধি পাচ্ছে, যাতে একটা নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর আহসান এইচ মনসুর যায়যায়দিনকে বলেন, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি

এটা দেশের জন্য কিছুটা হলেও সুখবর। তবে রপ্তানি আয় এখনো ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। তা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ে। কারণ রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি না হলে ডলারের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

তিনি আরও বলেন, দেশের প্রধান তিনটি সূচকের কিছুটা হলেও উন্নতর দিকে রয়েছে। তবে এসব পরিসংখ্যাগত উন্নয়ন। এটা দেখে সার্বিক অর্থনীতির বিবেচনা করা ঠিক হবে না। বিশ্ব মন্দার যে আশঙ্কা তা মোকাবিলা করতে হবে সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়। আর সেটা দূর করতে সময় লাগবে আরও ছয় মাস।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চলতি অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের সময় ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল না। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাই আশা করছি, অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

মূল্যস্ফীতি কমা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মজুরি বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি কমেছে। এটা খুবই ভালো দিক। কেননা নিম্ন আয়ের লোকেরা এ কারণে অস্বস্তিতে ছিল। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে আমরা যে ধারণা করেছিলাম তা বাস্তব হয়েছে।

সূত্র জানায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৭১৯ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি হয়েছে। পাশাপাশি গত অর্থবছরের একই সময় আয় হয়েছিল ২ হাজার ৪৬৯ কোটি ডলার। সে তুলনায় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত নভেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫০৯ কোটি ডলার। গত ডিসেম্বরে আয় হয়েছে ৫৩৬ কোটি ডলার। নভেম্বরের চেয়ে ডিসেম্বরে বেশি হয়েছে আয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ সামান্য বেড়েছে। ওই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৯ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। গত নভেম্বরে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০২১ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে প্রায় ৭ কোটি ডলার বেশি এসেছে ডিসেম্বরে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৩ কোটি ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৪৯ কোটি ৩২ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ২৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। সেই হিসাবে এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বেশি এসেছে।

ইপিবির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একক মাস হিসাবে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ডিসেম্বরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৪২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৫৩৬ কোটি ডলার। আয় কম হয়েছে ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আয় হয়েছে ৪৯০ কোটি ডলার। সে ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ১৯৪ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ২ হাজার ২৯৯ কোটি ডলার। আয় বেশি হয়েছে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ ছাড়া গত অর্থবছরের একই সময় আয় হয়েছে ১ হাজার ৯৯০ কোটি ডলার। সে ক্ষেত্রে একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। একইভাবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬৭ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৬৩ কোটি ডলার। সে ক্ষেত্রে আয় কম হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া গত অর্থবছরের একই সময় আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ডলার। সে ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৩ শতাংশ।

এদিকে বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে পণ্যমূল্য না কমলেও দেশের মূল্যস্ফীতিতে বিরাজ করছে নিম্নমুখী ধারা। গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। নভেম্বর মাসে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ হিসেবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি অনেক বাড়তি রয়েছে। এছাড়া গত মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশে, যা নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অপরদিকে গড় মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ।

বিবিএস বলেছে, গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ, নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ, নভেম্বর মাসে যেটি ছিল ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ।

এদিকে ডিসেম্বর মাসে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশে, যেটি নভেম্বর মাসে ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যেটি নভেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

বিবিএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডিসেম্বর মাসে মজুরি হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ০৩ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কৃষিতে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যেটি নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। এছাড়া শিল্পে মজুরি হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১২ শতাংশ, যেটি নভেম্বর মাসে ছিল ৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। সেবা খাতেও মজুরি হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা নভেম্বর মাসে ছিল ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে