মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দুর্নীতিই ছিল উন্নতির বড় প্রতিবন্ধকতা

২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে সিপিডি'র জরিপ
যাযাদি রিপোর্ট
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আপডেট  : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:১৭
দুর্নীতিই ছিল উন্নতির বড় প্রতিবন্ধকতা

দুর্নীতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে চ্যালেঞ্জ, আমলাতন্ত্র ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যবসার পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যবসার পরিবেশের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হতে হচ্ছে। এছাড়া লাইসেন্স নেওয়া, বিদু্যৎ-গ্যাস সেবা ও কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এ পরিস্থিতি আগের তুলনায় আরও খারাপ হয়েছে। এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে দুর্নীতিকে। গত বছর এই দুর্নীতিই ছিল ব্যবসায় উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডবিস্নউইএফ) এক যৌথ জরিপে উঠে এসেছে এসব তথ্য। রোববার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির সিপিডি কার্যালয়ে জরিপের ফল উপস্থাপন করেন সিপিডি'র গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত এই জরিপ চালানো হয়। এতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৭৪ জ্যেষ্ঠ ব্যবসায়ীর মতামত নেওয়া হয়।

জরিপে বলা হয়, বিগত বছরগুলোর মতো ২০২২ সালেও দুর্নীতি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতি ছাড়াও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জ, দুর্বল আমলাতন্ত্র, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার উত্থান-পতন ও নীতিগত সমস্যা ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধক।

জরিপ বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের অগ্রগতি দেখা যায়নি। হয় এটি স্থবির ছিল, নতুবা আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত কারণ হিসেবে 'দুর্নীতি'

এখনো রয়ে গেছে। তবে অন্যান্য কাঠামোগত এবং নতুন নতুন সমস্যার ফলে দুর্নীতির তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার, ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন, ঋণে সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া, বকেয়া ঋণে স্বচ্ছতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ইন্সু্যরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) কার্যকর ভূমিকা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয় সিপিডি।

সিপিডি'র গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম তার উপস্থাপনায় বলেন, দুর্নীতির কারণে শুধু উৎপাদন খরচ নয়, সেবার মূল্যও অনেকখানি বেড়ে যায়। এই মূল্যের ঘানিটা সাধারণ মানুষেরই ওপর পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে শুধু ব্যবসার পরিবেশ নয়, অর্থনৈতিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কোন কোন খাতগুলোতে দুর্নীতি হচ্ছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা, সেটা সব ধরনের ব্যবসায়ীরা বলেছেন। যেসব খাত এসেছে তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ৫৪ শতাংশ বলছেন, লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, গ্যাস, বিদু্যৎ নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৪৯ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী।'

গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, 'আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এসএমই উদ্যোক্তারা ঋণ পায় না। এক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া দরকার। পুঁজিবাজারে আগের মতোই দুর্বলতা রয়েছে। আর্থিক খাতে সুশাসন আনার ক্ষেত্রে সরকার যে আশ্বাস দিয়েছে, বিশেষ করে ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে সরকার সুশাসনের যে কথা দিয়েছে সেখান থেকে কাজ শুরু হতে পারে। সেখানে আর্থিক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে ঋণ খেলাপিদের কমিয়ে আনা প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে আমরা সেরকম সম্ভাবনা দেখছি না। বিদেশি বিনিয়োগ সমানভাবে আকৃষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কর কাঠামো সংক্রান্ত জটিলতা, অবকাঠামোগত ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতা ও দক্ষ জনবলের অভাবের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছি না। আমাদের দেশের নীতি কাঠামো যখন করা হয়, তখন সবার জন্য করা হয়। কিন্তু ছোট, মাঝারি ও বড়দের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নীতি দরকার। খাত ও আকারভিত্তিক উদ্যোগ দরকার।'

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'অর্থঋণ আদালতের সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে বন্দর সুবিধাগুলোর বিষয়ে অধিকাংশ ব্যবসায়ী অদক্ষ মনে করে। যা আমাদের জরিপে এসেছে।'

অনুষ্ঠানে সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'সারা বিশ্ব এখন একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ। যার মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যার ফলে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মন্দাভাব থাকবে। এটা থেকে উত্তরণ হচ্ছে না।'

তিনি বলেন, 'এসব কারণে বাংলাদেশের মতো দেশ হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ওই সব মূল্যস্ফীতির কারণে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ও ব্যবসায়ীরা এক ধরনের চাপে রয়েছে। ২০২২ এর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত যে জরিপ কাজ হয়েছে। ওই সময়ের পরে আগস্ট, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বেশকিছু নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সময়ে বিদু্যৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। যার চাপ ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাবে, মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমানের যে চেষ্টা রয়েছে তা কমে আরও বাড়বে। এর পাশাপাশি রপ্তানিকারক শিল্পগুলো উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।'

ফাহমিদা আরও বলেন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে রপ্তানি সক্ষমতা কমে এলে বড় একটি প্রভাব পড়বে রপ্তানি খাতে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমনিতেই কমার দিকে, সেখানে এমন সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। জরিপে যেসব সূচকের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম সূচক দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে শুধু উৎপাদন খরচ নয়, সেবার মূল্যও অনেকখানি বেড়ে যায়।'

প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সিপিডি'র পরামর্শ

ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জরিপে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা নেওয়া। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একটি বড় সংস্কার নিশ্চিত করা। আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। নাগরিক এবং ব্যবসায়িক সেবা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতে সংস্কার, নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ করার অঙ্গীকার করা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে