বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব

১১টি খাত চিহ্নিত হ ৫ বছর ৫ হাজার ৭৮৭টি প্রস্তাব জমা হ বিদায়ী বছরে ১ লাখ ২০ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব হ ৩৬টি দেশের বিনিয়োগ প্রস্তাব
পবন আহমেদ
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করায় নতুন করে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। বিদায়ী বছর ২০২২ সালে বিডায় বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে ১ লাখ ২০ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। আর গত ৫ বছরে ৫ হাজার ৭৮৭টি বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে জমা পড়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। জমাকৃত প্রকল্পগুলোর মধ্যে মোট ৩৬টি দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব করেছে। বিনিয়োগের খাতগুলো হচ্ছে অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্য প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র ও বস্নু-ইকোনমি। ফলে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়াতেও সহায়তা করবে। বিডা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, শুরুর তিন বছরের নিম্নমুখী প্রবণতা কাটিয়ে ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি। তারা বলছেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ওই বছরের ফেব্রম্নয়ারি মাসে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও এক দফা বেড়েছে, বেড়েছে ডলারের বিনিময় হার। সেই সঙ্গে কমতে শুরু করেছে প্রবাসী আয়। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এই জোড়া ধাক্কায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত অনেকটা কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে বিডার তথ্য।

সূত্রে জানা গেছে, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৮টি দেশে একতরফা শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। ৩৬টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত করারোপণ পরিহার চুক্তি বলবৎ আছে। বর্তমানে ৭৯টি পিপিপি প্রকল্পে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এছাড়া ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে ৩৫টি সংস্থার ১৫৪টি বিনিয়োগ সেবা অনলাইনে প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।

বিডার তথ্যে দেখা যায়,

গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। যা ৫ হাজার ৭৮৭টি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এতে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের প্রাক্কলন করা হয়। এসব প্রস্তাবে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট বিনিয়োগ প্রস্তাবের ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ বা ৯৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব আসে শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। ৪ লাখ ৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার স্থানীয় বিনিয়োগের প্রস্তাবে দেশে কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা করা হয় ৮ লাখ ৫৫ হাজার ২০৬ জনের। অন্যদিকে শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৫২৫ জনের কর্মসংস্থানের প্রাক্কলন করা হয়।

বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশন একীভূত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিডা। এরপর থেকে দেশে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আনতে কাজ শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশিদের বিনিয়োগের প্রসারে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দিতে কাজ করে আসছে বিডা।

বিডার তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে বিনিয়োগ প্রস্তাব কমে ৮৪ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা বা ৩৯ শতাংশ। পরের বছর আরও ১৬ শতাংশ কমে বিনিয়োগ প্রস্তাব দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকায়। করোনাকালে বিনিয়োগ আগ্রহ নেমে আসে তলানিতে। ওই সময় আগের বছরের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বিনিয়োগ প্রস্তাব কমে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৮০৬ কোটি টাকায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ। ২০২১ সালে আগের বছরের চেয়ে ৫২ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা বা ৮৬ শতাংশ বিনিয়োগ প্রস্তাব বৃদ্ধি পায়। সদ্য শেষ হওয়া বছরেও এই ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগ প্রস্তাব বেড়েছে ৬ শতাংশ। ২০২২ সালে বিডায় বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে ১ লাখ ২০ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। তবে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের পর পর্যন্ত টানা কমেছে শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব। ২০১৮ সালে শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব আসে ৪১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে যা নেমে আসে ৮ হাজার ৫২৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ শতাংশের হিসেবে চার বছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৭৯ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে বিদেশিদের বিনিয়োগের আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে। ওই বছর বিদেশি উদ্যোক্তারা ২৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দেয় বিডার কাছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৪৫ শতাংশ বেশি। এসব প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্থানীয় বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল সেবা খাত, রাসায়নিক ও টেক্সটাইল শিল্প। এ ছাড়া মোট বিনিয়োগের ২৪ শতাংশ টেক্সটাইল ও ১৮ শতাংশ সেবা খাতের লগ্নির প্রস্তাব দেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। সদ্য শেষ হওয়া ২০২২ সালে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ আকর্ষণ ছিল রাসায়নিক শিল্প খাতে। মোট বিনিয়োগ প্রস্তাবের ২১ শতাংশই ছিল এ খাতের। যা বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৮ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। আর প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল সেবা ও টেক্সটাইল খাত।

২০১৯ সালে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু ও সম্প্রসারণে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) চালু করে বিডা। এই ওএসএসের অধীনে ৬৩টি বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করে থাকে সংস্থাটি। এর মধ্যে ১৮টি সেবা নিজেই দিয়ে থাকে বিডা। বাকি ৪০টি সেবা ২২টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দিয়ে থাকে বিনিয়োগ উন্নয়নের এই সংস্থা। যার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিও সই করেছে বিডা। এর মধ্যে আছে বিদু্যৎ সংযোগ, পানি সরবরাহ, জমি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, আমদানি-রপ্তানির নিবন্ধন, কনস্ট্রাকশন অনুমোদন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, টিন নম্বর প্রদান, ভিসা প্রসেসিং ও মেয়াদ বৃদ্ধির মতো কার্যক্রম। ফলে ঘরে বসেই অতি দ্রম্নত ও স্বল্প ব্যয়ে বিনিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে