বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি দেখিয়ে প্রতারণা : দেশজুড়ে অভিযান

গোয়েন্দা জালে দুই শতাধিক প্রতারক
গাফফার খান চৌধুরী
  ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি দেখিয়ে প্রতারণায় অভিযুক্ত দুই শতাধিক প্রতারক এখন গোয়েন্দা জালে। তাদের গ্রেপ্তারে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিনব এসব প্রতারক প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে। এসব প্রতারকের প্রতারণার ধরন অনুযায়ী ডিজিটাল তালিকা তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে। এমন অভিনব প্রতারণার ঘটনায় চলতি বছর দেশে তিন শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফটোশপের মাধ্যমে ছবি জুড়ে দিয়ে অফিসে টাঙিয়ে রেখে প্রতারণা করছিল মোহম্মদ আলী ও তার সহযোগী সুরেন্দর নাথ ঢালী। তারা বহু মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়। পরে ভোলা জেলার লালমোহন থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ওই দুই প্রতারককে। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবিগুলো এডিট করে বসানো হয়েছিল। আসামিরাও জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিসহ প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা অফিসে বাঁধিয়ে রেখে অনেক প্রতারণার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এমন মামলার সংখ্যা তিন শতাধিক। এসব মামলার তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নানা ধরনের অপরাধের সংখ্যাও। বিশেষ করে সামাজিক

যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। যার মধ্যে রয়েছে অন্যের ফেসবুক হ্যাক করে প্রতারণা। আবার পরিকল্পিতভাবে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজের পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে অশ্লীল ভিডিও জুড়ে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। অনেকের মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন বা স্পুফিং করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, জাল কাগজপত্র বানিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সিল-স্বাক্ষর নকল করেও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের প্রতিটি প্রতারণার সঙ্গেই প্রযুক্তির যোগসূত্র রয়েছে।

সূত্রটি বলছে, গত কয়েক বছর ধরে অভিজাত এলাকায় সুসজ্জিত অফিস ভাড়া নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। এসব অফিসে সমাজের অতিপরিচিত, প্রভাবশালী ও অত্যন্ত গুণীজনদের সঙ্গে ছবি জুড়ে দিয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়। যাতে সহসাই যে কারও চোখে পড়লে প্রথম দফায় ধাক্কা খায়। অফিসের সার্বিক পরিস্থিতি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা রীতিমতো হতবাক করার মতো। আবার হরহামেশাই অফিসে প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপিদের আসার কথা আছে বলে প্রচার করা হয়। আসলে সবই লোক দেখানো। মূলত এর নেপথ্যে রয়েছে অফিসের কর্তা-ব্যক্তিদের ক্ষমতা জানান দেওয়া। অনেক সাধারণ মানুষ এসব ব্যক্তির দ্বারা হরহামেশাই প্রতারিত হচ্ছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি দেখিয়ে প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের একটি পৃথক ডাটাবেজ তৈরি অব্যাহত আছে। যেসব প্রতারক গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রাখা হয়েছে সেই ডাটাবেজে। যাতে ভবিষ্যতে তারা যে কোনো ধরনের অপরাধে জড়িত হলে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি কারাগারে থাকা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতারকদের সম্পর্কে তথ্য জানা হচ্ছে। কোন প্রতারক কি ধরনের প্রতারণায় জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে বা কারাগারে প্রবেশ করছে তাও রাখা হচ্ছে ডাটাবেজে। এতে করে কোনো প্রতারক জামিনে বেরিয়ে গেলেও তার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যা প্রতারণার মামলার তদন্তে সহায়ক হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যে ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে তাতে দুই শতাধিক প্রতারক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এসব প্রতারকদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে। তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এক কথায় তাদের গোয়েন্দা জালে রাখা হয়েছে।

ডিজিটাল প্রতারণার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনজুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, দেশের সব থানা ও বিভিন্ন ইউনিটকে যে কোনো অভিযোগ বা মামলা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। তবে প্রতারণা বা অপরাধের ধরন অনুযায়ী সঠিক আইন মোতাবেক মামলা দায়ের করতে বলা হয়েছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী মামলা করতে হবে। আর মামলার মেরিট অনুযায়ী তদন্ত করার কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবব্দুলস্নাহ আল-মামুন।

সাইবার অপরাধ বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব মামলা হয়, সেসব মামলার তদন্ত করেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্তে পারদর্শী কর্মকর্তারা। তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলা বা সেই ছবি এডিট করে প্রতারণার বিষয়টি ভিন্ন। এক্ষেত্রে মামলা হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোন ব্যক্তি কার সঙ্গে ছবি তুলবেন বা তুলবেন না, এটি ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় বা ইচ্ছা বা অনিচ্ছার বিষয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এসব বিষয়ে সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

র্

যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে বা নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসা রিজেন্ট হাসপাতালের বহুল আলোচিত মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম গ্রেপ্তারের পর প্রতারণার এমন অভিনব বিষয়টিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছের্ যাব। এজন্য প্রতারণার বিষয়ের্ যাব সদর দপ্তর, সব ব্যাটালিয়নের গোয়েন্দা শাখা ও সাইবার বিভাগ প্রতারণা নিয়ে গভীরভাবে কাজ করছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

তিনি জানান, প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রযুক্তিগত মাধ্যমে অপরাধ বাড়ছে। এসব অপরাধের বিষয়ের্ যাব সতর্ক আছে। এজন্য সাইবার পেট্রোলং বাড়ানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত অপরাধে গ্রেপ্তার ও ছাড়াপ্রাপ্তদের একটি ডিজিটাল তালিকা রাখা হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে প্রতারণার সংক্রান্ত নানা অপরাধে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ও তদন্তে কাজে লাগবে। কারণ তদন্তে দেখা গেছে একই ধরনের প্রতারক জামিনে বেরিয়ে আরও অভিনব কায়দায় প্রতারণার চেষ্টা করে।

প্রযুক্তিগত প্রতারণার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ডক্টর জিয়াউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে। স্বাভাবিক কারণে প্রযুক্তিগত অপরাধও বাড়ছে। বিশেষ করে ভুয়া ফেসবুক আইডি তৈরি করে প্রতারণা, প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি তুলে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উচিত যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করা। এ ধরনের প্রতারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে এসব অপরাধ কমে আসবে বলেও তিনি মনে করেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন অর-রশীদ বলেন, ডিবি প্রযুক্তিগত নানা অপরাধের বিষয়ে দায়েরকৃত মামলা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে অন্য অপরাধীদের পাশাপাশি এ ধরনের অপরাধীদের তৎপরতা বাড়ার আশঙ্কায় নজরদারি ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির মিডিয়া উইংয়ের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার আইনে দায়েরকৃত বহু মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে