শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহনে বেপরোয়া চালক!

দীর্ঘ হচ্ছে সড়কে মৃতু্যর মিছিল

বেপরোয়া গতির কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়কে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের যথেষ্ট তৎপরতা নেই
সাখাওয়াত হোসেন
  ২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

গত শুক্রবার বিকালে পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশার মঠবাড়িয়া সড়কে চলন্ত নসিমনের চাকা খুলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে যাত্রীরা রাস্তায় ছিটকে পড়েন। এ সময় বেপরোয়া গতিতে বিপরীত দিক থেকে আসা গ্রামীণ পরিবহণের এক বাস তাদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলে দুইজন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও তিনজন মারা যান। ঘটনায় আহত হন ১১ জন।

এ ঘটনার পর ৪০ ঘণ্টা না পেরোতেই মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে যাত্রীবাহী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ১৯ যাত্রী নিহত এবং ৩০ জন আহত হন। বাস যাত্রীরা জানান, বেপরোয়া গতিতে চলা গাড়ির সামনের চাকা আকস্মিক ফেটে যাওয়ার পর চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

২ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে জ্বালানি তেলবাহী গাড়ির সামনের চাকা ফেটে ছুটে আসা চাকার লোহার রিংয়ের আঘাতে রাস্তার পাশে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ এক কলেজ শিক্ষকের মৃতু্য হয়। এ ঘটনায় তার স্ত্রীও গুরুতর আহত হন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, গাড়ির টায়ারে গ্যাস থাকে। তাই এটি গ্যাসের চাপীয় সূত্র মেনে চলে। গ্যাসের চাপের সূত্রটি হচ্ছে, আয়তন স্থির থাকলে কোনো গ্যাসের তাপমাত্রা ও চাপ পরস্পর সমানুপাতিক। অর্থাৎ তাপমাত্রা বাড়লে চাপ বাড়বে। চলন্ত অবস্থায় গাড়ির টায়ার এবং রাস্তার মাঝে ঘর্ষণের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে গাড়ির টায়ারে থাকা গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি পায়। গাড়ির টায়ারের এই চাপ সহ্য করার একটি নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। গ্যাসের চাপ যদি এই সীমা অতিক্রম করে তবে টায়ারটি ফেটে যায়। তাই গাড়ি চালানোর আগে টায়ারটি মানসম্মত রয়েছে কি না তা যাচাই করা উচিত। এছাড়া টায়ারের মান বুঝে গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। অথচ দূরপালস্নার বেশির ভাগ যানবাহন চালকই এসব নিয়ম মানছেন না। এ কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

সড়ক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন ও বেপরোয়া গতির কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়কে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের যথেষ্ট তৎপরতা নেই। সড়ক-মহাসড়কে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে হাইওয়ে পুলিশসহ অন্যান্য

প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও ক'দিন না যেতেই তা ঝিমিয়ে পড়ে।

সড়ক দুর্ঘটনার ওপর গবেষণা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তার মধ্যে শতকরা ৪৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। ৩১ শতাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় প্রধান কারণ এই বাড়তি গতি। তাই দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বলেছে সংস্থাটি।

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পরিবহণ মালিক-চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন করে তোলা একটি সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭ দশমিক ৮০ শতাংশ; ক্রটিপূর্ণ যানবাহন পরিচালনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে ২৪ শতাংশ। পথচারীদের অসতর্কতা ও অবহেলার জন্য ৩৮ দশমিক ২০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া মাদক গ্রহণ করে গাড়ি চালানো, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক ও পথচারীদের না মানার প্রবণতাকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন তারা। যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা এবং ব্যবহার উপযোগী না থাকা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাটিং করা এবং সড়কঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে ওঠায় পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে বলেও দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, যানবাহন চালকদের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে তারা নিয়মিত নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে গাড়িচালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে তাদের বাগে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কোনো কোনো সময় নির্দিষ্ট স্থানে গতি পরিমাপক যন্ত্র বসিয়ে দুই-একটি যানবাহনের চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরপরই তা অন্য চালকরা জেনে যান। এ কারণে তারা ওই স্থানে আসার আগেই যানবাহনের গতি কমিয়ে দেন। আবার স্থানটি পার হওয়ার পরপরই গতি বাড়িয়ে দেন। এ কারণে শুধু গতি পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে গতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এআরআইয়ের এক গবেষণা তথ্য বলছে- সোজা পথে দুর্ঘটনা ঘটে ৬৭ শতাংশ, বাকিটা সড়কের বাঁকে। সোজা পথে যানের গতিও থাকে বেশি। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ কিলোমিটার গতির একটি যান যদি কোনো মানুষকে ধাক্কা দেয় তাহলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে ৯৫ শতাংশ। এই গতি ৪০ হলে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে ৪৫ শতাংশ। আর যানের গতি ৫০ কিলোমিটার হলে ধাক্কা লাগা ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে মাত্র ৫ শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সূত্র মতে, ফিটনেসবিহীন ত্রম্নটিপূর্ণ গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬৯টি। শুধু ঢাকা শহরে রয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩০৮টি। আর নিবন্ধিত গাড়ির চেয়ে চালকের সংখ্যা কম। দেশে বর্তমানে ৪১ লাখ গাড়ি রয়েছে। চালক রয়েছেন প্রায় ৩২ লাখ। এ হিসাবে লাইসেন্সবিহীন ৯ লাখ চালকের হাতে রয়েছে গাড়ির স্টিয়ারিং। যে সংখ্যা প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর সঙ্গে যান্ত্রিক ছোট যানবাহনের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ায় এবং মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল বন্ধে প্রশাসনের যথেষ্ট তৎপরতা না থাকায় দুর্ঘটনায় মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী, গেল বছর দেশে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জনের প্রাণ ঝরেছে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১২ হাজার ৩৫৬ জন। সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এ সংখ্যা গত আট বছরের সর্বোচ্চ।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তাতে মৃতু্য ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন, বিশেষ করে মোটর সাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আদালতের আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ইজিবাইক, মোটর সাইকেল ও থ্রি-হুইলার চলাচল করছে। যা সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯ হাজার ৬১৬টি দুর্ঘটনার মধ্যে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাস, ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ-কাভার্ড ভ্যান ও লরি, ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৬ দশমিক ২২ শতাংশ অটোরিকশা, ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ মোটর সাইকেল, ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক এবং ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা ও লেগুনার সঙ্গে সংঘটিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৫২ দশমিক ২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে। সারা দেশে হওয়া মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, এক দশমিক ৭১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে হয়েছে।

এদিকে দেশে সড়ক-মহাসড়কে ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়লেও এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা কত তার সংখ্যা খোদ বিআরটিএ'র (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) জানা নেই। এছাড়া হাজার হাজার লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন অবৈধভাবে ফিটনেস সনদ যোগাড় করে সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ালেও সে ব্যাপারে সরকারের এ সংস্থাটি বরাবরই উদাসীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোদ রাজধানীতে ২ হাজারেরও বেশি ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল করছে। পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বাসগুলোর বেশির ভাগই 'জ' সিরিয়ালের। এগুলোর বয়স ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আবার নতুন 'ব' সিরিয়ালের বাসের অবস্থাও ভালো নয়।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া বন্ধ বহুদিন ধরেই। কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে পুরনো বাসগুলোকে আর ফিটনেস দেওয়া যায় না। তবু ফিটনেসবিহীন বাসগুলোর চলাচল কিন্তু বন্ধ হয়নি।

যদিও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার রাজধানীতে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন চলার কথা মানতে চাননি। তার ভাষ্য, আমাদের নিয়মিত অভিযান চলমান আছে। এ ধরনের যানবাহন আটকানো হচ্ছে। ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন ফিটনেস সনদ নিচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।

পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব ভাঙাচোরা বাস চলছে, সেগুলো ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য কখনো বিআরটিএ কার্যালয়ে নেওয়া হয় না। বাস থাকে রাস্তা বা গ্যারেজে। আর ফিটনেস সার্টিফিকেট আসে বিআরটিএ কার্যালয় থেকে। পুরো কাজটাই 'বিশেষ ব্যবস্থায়'।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সারা বছরে বিআরটিএ'তে ৬ লাখ যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা হয়। এর বেশি হয় না। এর অর্থই হলো বাকি ১০ থেকে ১২ লাখ যানবাহন ফিটনেস ছাড়াই চলাচল করছে।

বিআরটিএ'র একটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত অর্থবছরে যানবাহন নিবন্ধনের সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে বাড়লেও, একই সময়ে ফিটনেস সনদ নেওয়া যানবাহনের সংখ্যা ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। ফলে ফিটনেস সনদহীন যানবাহনের সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বিআরটিএকে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে কঠোর হতে হবে। তা না হলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি আরও বাড়বে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য বিআরটিএকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করে সড়ক শৃঙ্খলা আনতে হবে। এটি না হলে অনেকে বিভিন্ন জনকে ম্যানস ফিটনেস ছাড়াই গাড়ি চালানোর দিকে ঝুঁকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে