শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বড় শক্তিগুলোর শুরু হওয়া বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা দীর্ঘদিন ধরে চলমান রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে নানা জোট-উপজোট হওয়ায় সেই পালস্না এখন আরও বেড়েছে। একতরফা ভোটে জয়ী হওয়ার সমালোচনা কাঁধে নিয়ে সদ্য গঠিত নতুন সরকারকে পূর্বের দেশগুলো অভিনন্দন জানালেও পশ্চিমারা এখন 'নেতিবাচক' আচরণ করছে। এ পরিস্থিতিতে সার্বিক ভারসাম্য রক্ষা করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করাই নতুন সরকারের কূটনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে অপরিবর্তিত আছে। রাশিয়া, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের তেমন হেরফের হয়নি। কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে নতুন বছরে স্পর্শকাতরতা বাড়তে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়েও আলোচনা আছে। রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এই সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে এ সংকট নিয়ে নতুন সরকারের দুশ্চিন্তা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানি বাড়ানোও বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, রপ্তানি না বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে বিদেশে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের আরেক খাত জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, নির্বাচনের আগে থেকে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য করা যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সদ্য গঠিত সরকারকে আলাদা দৃষ্টি রাখতে হবে। যে কোনো কৌশলে তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাতে হবে। কূটনৈতিক অদক্ষতায় পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে এবং এ পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষ থেকে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা এলে সে চাপ সামাল দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হবে।

অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। কেননা রাশিয়া, ভারত ও চীনসহ যে দেশগুলোর সঙ্গে নতুন সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে, এর কোনোটিই বাংলাদেশ থেকে বড় কোয়ান্টিটির কোনো পণ্য ক্রয় করে না। বরং বাংলাদেশই উল্টো এসব দেশগুলোর বড় ক্রেতা। তাই গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের তাগিদ দেন তারা।

কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবীর বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান

বাস্তবতায় যদি কূটনৈতিক সক্ষমতা আরও গভীর করা যায়, তাহলে আগামী দিনে বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক চাহিদা এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হওয়া উচিত। আর এজন্য অবশ্যই ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কাজ করতে হবে এবং এর ভিত্তি তৈরি করতে হবে।

এই কূটনীতিকের মতে, কারো সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা কঠিন হবে। তাই আমাদের এখানে কৌশলগত কূটনীতি করতে হবে। আগামী দিনেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত থাকতে হবে। কারণ এই সম্পর্কটা খুবই অসম। এটাকে আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হিসেবে দেখি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বৈশ্বিক সম্পর্কের আলোকে দেখে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি, এক নম্বর সামরিক শক্তি, কূটনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ এবং সেখানে প্রায় এক মিলিয়ন বাংলাদেশি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে দেশ সর্বাধিক রেমিট্যান্স পাচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের দেশগুলো আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য।

অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্নভাবে কাজ করছে। তারা জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইসু্যতে আমাদের সবচেয়ে বড় সমর্থক। তাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত কোনো সমস্যা নেই। রাশিয়ায় যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রয়েছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত রয়েছে। ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই এখনই প্রস্তুতি শুরু করা দরকার। বিশেষ করে ২০২৬ সালে আমরা কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব এবং উন্মুক্ত বিশ্বে আমাদের জন্য কীভাবে মর্যাদাপূর্ণ জায়গা তৈরি করতে হবে সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।

এদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করাই এবারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, 'ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। তারা যখন গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাদেরকে বেশ শক্ত ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে। সুসম্পর্ক তৈরি করার উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হবে।'

উলেস্নখ্য, গত ৭ জানুয়ারি দেশে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক জোট। সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, তাদের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট যে, নির্বাচন নিয়ে তাদের আগের যে অবস্থান ছিল তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারত, চীন ও রাশিয়া কোনো অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিকল্প নয়- এ বিষয়টিও সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন ওই কূটনীতিকরা।

এদিকে নানামুখী সংকট অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেভাবে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি তার জাদুকরী নেতৃত্বে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবেন এমনটাই আশা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ প্রসঙ্গে সদ্য গঠিত সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, 'তিনি (শেখ হাসিনা) বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে দক্ষতা, দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন এবং সংকটে রূপান্তরের রূপকের ভূমিকা পালন করেছেন, সে কারণেই মূলত আমরা সাহস রাখি, আশা রাখি।'

তবে বাংলাদেশের জন্য আগামী ছয় মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ উলেস্নখ করে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, 'এরই মধ্যে আমরা ধারণা পাব পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে। আর কিছু না হোক নির্বাচন ঘিরে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায় আগের মতো ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসবে এবং এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তেমন কোনো পরিবর্তনও আশা করা যায় না। এতে দেশের জন্য চিন্তারও কিছু নেই। কারণ দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।'

যদিও কূটনীতিকরা অনেকেই মনে করেন, অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করায় বাণিজ্যিক কূটনীতিতে বড় সংকটের আশঙ্কা করছেন না তারা।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, অভ্যন্তরীণ যে সমস্যাগুলোর কারণে বাংলাদেশে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির যে শঙ্কা রয়েছে, তা থাকবে না; বরং পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। নির্বাচনের আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, ভূ-রাজনৈতিক টানাহেঁচড়ায় পড়তে পারে বাংলাদেশ, তা মোকাবিলায় সরকারকে যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে।

এদিকে বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের চাপ ছিল নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে। এর মাধ্যমে বিদেশি শক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আবার দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ঝামেলা চলছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হলে বিরোধীদের আন্দোলন জোরদার হতে পারে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু মনে না করা শক্তিগুলোর সমর্থনে ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। যা সার্বিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলবে।

এদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন 'অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি' বলে যুক্তরাষ্ট্র যে বিবৃতি দিয়েছে তার একাংশ উলেস্নখ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে সেখানে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কাজ করার কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের কথা বলা হয়নি। কেননা যে সরকারকে তারা মনে করছেন যে, সরকারটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়নি। অর্থাৎ তাদের যে পাবলিক ম্যান্ডেট সেটা নেই। তার সঙ্গে তাহলে তারা কীভাবে কাজ করবেন।

তিনি আরও বলেন, 'এ প্রশ্নটি আমেরিকাকে মোকাবিলা করতে হবে। ফলে আগামীতে কী হবে, পাঁচ বছরের জন্যই এটা একটা স্থির জায়গায় চলে গেছে আমি সেটা মনে করছি না। সবেমাত্র নির্বাচন হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা ইতিবাচক নয়। ফলে এগুলো কিন্তু ভিন্ন রকম ইঙ্গিত দেয়- যোগ করেন আলী রীয়াজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে