শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
মিয়ানমার জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের লড়াই তুঙ্গে

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে উত্তেজনা সতর্ক অবস্থানে বাংলাদেশ

এই সংঘাতের আঁচ মিয়ানমারের সীমান্ত ছাপিয়ে বাংলাদেশেও লেগেছে বেশ কয়েক দিন ধরে। মাঝেমধ্যে গুলির খোসা ও মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তবাসীর বাড়িতে। ফলে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা বাড়ছে
যাযাদি ডেস্ক
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে উত্তেজনা সতর্ক অবস্থানে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য গুলি ও মর্টারের শব্দে প্রকম্পিত। সেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে তীব্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা। দিন যাচ্ছে আর জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে পরিস্থিতি। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রম্নপের সঙ্গে সীমান্তবর্তী প্রদেশে সামরিক বাহিনীর লড়াই এখন তুঙ্গে। এই সংঘাতের আঁচ মিয়ানমারের সীমান্ত ছাপিয়ে বাংলাদেশেও লেগেছে গত বেশ কয়েক দিন ধরে। মাঝেমধ্যে গুলির খোসা ও মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তবাসীর বাড়িতে। ফলে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম, তুমব্রম্ন ও কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাশাপাশি আবারও রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা এ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে আরাকান সলভেশন আর্মি শক্তি বাড়িয়ে গত প্রায় ১৫ দিনে দু'টি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে। তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার সরকার। এখন থেকে তিন বছর আগে মিয়ানমারে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকে হটিয়ে ক্ষমতা নেয় সামরিক সরকার। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জান্তাবিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন তাদের শক্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। এসব গ্রম্নপই জান্তা সরকারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করে। তিন বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির শান ও রাখাইন প্রদেশে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে জান্তাবিরোধী এসব গোষ্ঠী মিয়ানমারে ৩শ'র বেশি সামরিক চৌকি এবং ২০টি শহর দখল করে নিয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারে চলা ওই সংঘাতের আঁচ এসে লেগেছে বাংলাদেশের সীমা অঞ্চলে। এর আগে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে নিরাপত্তার কারণে সীমান্তের পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। বন্ধ ঘোষিত স্কুলগুলোর মধ্যে ছিল- বাইশফারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রম্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রম্ন পশ্চিমকূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজু গর্জন বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

বুধবার অবিস্ফোরিত তিনটি মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়ির ঘোনারপাড়া লোকালয়ে এসে পড়ে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে সোমবার দুপুরে কোনারপাড়া এলাকায় বিস্ফোরিত মর্টার শেলের খোসা পাওয়া যায়। মঙ্গলবারও দিনগত রাতে ঘোনারপাড়া এলাকায় মিয়ানমার থেকে নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এসব ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে থেমে থেমে সংঘাত চলছে। সংঘাতে বিভিন্ন সময় নিক্ষিপ্ত গোলা তাদের সীমানা পেরিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী লোকালয়ে এসে পড়ছে। এতে নিত্যদিনের কাজে ও শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা।

তুমব্রম্ন ঘোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু সিদ্দিক বলেন, 'মধ্যরাতে গোলাগুলি শুরু হলে ভয়ে কাঁচাঘরের বাসিন্দারা পাড়ার বা কাছাকাছি পাকা দালানে গিয়ে আশ্রয় নেন। মঙ্গলবার রাতে যখন আবারও গোলাগুলি শুরু হয় তখন অন্যের ঘরে আশ্রয় না পেয়ে সীমান্ত সড়কের ওপারে আশ্রয় নিয়েছিলাম।'

টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম জানান, 'শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সীমান্তের মিয়ানমারের ওপার থেকে মর্টার শেল ও ভারি অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ ভারি অস্ত্রের একটা গুলির শব্দ খুব কাছ থেকে শুনতে পাই। তখন দেখি আমার বসতঘরে টিনের দরজা ছিদ্র করে একটি গুলি ঢুকে পড়ে। পরে বিজিবির সদস্যরা খবর পেয়ে তারা এসে গুলিটি নিয়ে যায়।'

স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু জানান, টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, তুলাতুলি ও কানজরপাড়া সীমান্তের মিয়ানমারের ওপারে সপ্তাহজুড়ে প্রচুর গোলাগুলি চলছে।

\হভয়ে আমরা বাড়ি ঘরে থাকতে পারছি না এবং চিংড়ি ঘেরেও যেতে পারছি না। এখন আমাদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে। অনেকে পরিবার দূরে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।'

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'তুমব্রম্ন সীমান্তে কোনাপাড়া ও পশ্চিমকুল পাড়া এলাকায় মিয়ানমারের ছোঁড়া তিনটি মর্টার শেল এসে পড়েছে। আমার এলাকায় পশ্চিমকূলে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম ও সাবেক মেম্বার গফুর চৌধুরীর বাড়ির উঠানে এসে মর্টার শেল পড়েছে। তবে কেউ হতাহত হয়নি।'

সূত্র মতে, মিয়ানমার-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে মিয়ানমার অংশে গত তিন দিনে অর্ধশতাধিক মর্টার শেলের প্রকট শব্দে ৪৭ ও ৪৮ নম্বর সীমান্ত পিলারের বাংলাদেশের অভ্যন্তর কেঁপে উঠেছে। আর এ কাঁপুনিতে আতঙ্কিত সীমান্তবাসী।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, 'মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমাদের কেউ হতাহত না হলেও আতঙ্কে রয়েছে বাসিন্দারা।'

ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো বলেন, 'আমরা যারা এপারে বসবাস করছি সবাই আতঙ্কে আছি, কখন কোন সময় কি হয় জানি না। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে না যাওয়ার জন্য স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে।'

এদিকে বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলি সাবরিন জানান, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ যেন কো?নোভা?বে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং নতুন ক?রে দেশ?টি থে?কে যেন রো?হিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সরকার বিশেষভাবে নজর রাখছে।

তিনি ব?লেন, 'মিয়ানমারে আমাদের দু'টি কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। তারা সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে মন্ত্রণালয় সরকারের সব কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করছে। এছাড়া আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে