মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
একই পথে জামায়াত

উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা বিএনপির

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এর আগে, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতায় ছিলেন দলের তৃণমূলের নেতারা। কারণ, বিএনপি নেতৃত্ব এতদিন সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কমবেশি বিএনপির ৪৫ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এদিকে, জাতীয় নির্বাচন বয়কট করা নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে শুরুতে নমনীয় ছিল। পরে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটি সোমবার রাতে বৈঠক করে বর্তমান সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বর্জনের ধারাবাহিকতায় উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রহসনের অংশীদার হতে চায় না বিএনপি। সে কারণে ৮ মে থেকে শুরু হওয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব এত দিন সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কমবেশি বিএনপির ৪৫ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে যারা ভোটের মাঠে নেমেছেন, তাদের ব্যাপারে বিএনপি কতটা কঠোর হতে পারবে, এখন সেই আলোচনা সামনে এসেছে।

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের নেতাদের যারা প্রার্থী হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে ২২ এপ্রিল।

\হদলটির এই বার্তা ভোটে আগ্রহী তৃণমূলের নেতাদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারাও বলছেন, দলের যারা ইতোমধ্যে প্রার্থী হয়েছেন, তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশনা পাঠানো হবে।

উপজেলার ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিএনপির যুক্তি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনও হবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। তারা অংশ নিলে আওয়ামী লীগই রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি তাদের দলের পুরানো অবস্থান। তারা সেই অবস্থানেই অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তবে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির যে ৪৫ জন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, এই সংখ্যাটা বেশি নয় বলেও মনে করছে বিএনপি। গয়েশ্বর রায় বলেন, তারা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, তৃণমূলে কর্মীদের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন করার আগ্রহ সেভাবে নেই।

এমন বক্তব্যের ব্যাপারে যুক্তি হিসেবে গয়েশ্বর রায় বলেন, সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন ও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাদের লাখ লাখ নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত। ২৭ হাজার বেশি কারাগারে গেছেন। ফলে তৃণমূলের কর্মীরা নতুন করে মামলা বা নির্যাতনের মুখোমুখি হতে চান না। এই পরিস্থিতি অগ্রাধিকার পেয়েছে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে।

তবে যারা ভোটের মাঠে নেমেছেন, তাদের তিনজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, শেষ মুহূর্তে দলের সিদ্ধান্ত তারা সন্তুষ্ট নন। তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

ঢাকার অদূরে গাজীপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ওই উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইজাদুর রহমান। তিনি বলেন, 'এখন দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমি গত দুইদিনে আমার উপজেলায় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাদের আগ্রহের কারণে আমি প্রার্থী হয়েছি।'

দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে ভোট করলে দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে, সে ব্যাপারে ইজাদুর রহমানের বক্তব্যে মনে হয়েছে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে চান।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছে, দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে নেতারা ঝুঁকি নিয়ে ভোট করবেন, এই সংখ্যা বেশি হবে না।

সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতও

এদিকে, জাতীয় নির্বাচন বয়কট করা নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে শুরুতে নমনীয় ছিল। পরে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ঈদুল ফিতরের পরপরই দলটি তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে জানিয়ে দিয়েছে। এর আগেই জামায়াতের অন্তত ২৫ জন নেতা প্রথম ধাপের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন বলে দলটির নেতারা বলছেন।

জামায়াতের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেনন, নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও নানা হিসাব-নিকাশে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ভোট হবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। এমন নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভালো করার সম্ভাবনা খুবই কম বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর।

জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ঈদের পরই দলীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার এ সিদ্ধান্ত হয়।

যদিও এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে শুরুর দিকে কিছুটা নমনীয় ছিল জামায়াত। জামায়াত অধু্যষিত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়ে দল ও ব্যক্তি জনপ্রিয়তায় জয়ের সম্ভাবনা আছে, এমন উপজেলাগুলোতে নির্বাচন করার ব্যাপারে দলের মাঠপর্যায়ে বার্তা ছিল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও জেলা কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

তবে, প্রথম পর্বের উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখের আগেই সিদ্ধান্ত বদল আনে দলটি। অবশ্য এই নির্বাচনে যাওয়া বা বয়কটের সিদ্ধান্তের কোনো বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

উপজেলা নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়ে আসা জামায়াতের বিভিন্ন প্রার্থী, একাধিক জেলা জামায়াতের নেতাদের বক্তব্যে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি স্বীকার করেছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়ার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ। তিনি বলেন, আমরা প্রথমে নমনীয় ছিলাম। যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী, জনপ্রিয় অথবা দলগত জনসমর্থন যে জেলায় বেশি, সেখানে অনেক জামায়াতের নেতা প্রার্থী হিসেবে প্রচারণায় ছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল নির্বাহী পরিষদের বৈঠক থেকে উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত হয়।

কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ধারার বিপরীতে। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজনে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান চলমান অবস্থায় আমাদের মনে হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মতোই জোরপূর্বক তাদের প্রার্থীদের জয়ী করার যে মানসিকতা... সেখানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকার দলের ক্ষমতায় থাকার জবরদখল মানসিকতার কারণেই আমরা এই নির্বাচন বয়কট করছি।

ঠিক কতজন প্রার্থী উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে প্রচারণায় ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমরা সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত দেইনি। তবে, প্রত্যাহার বা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। জেলা ও উপজেলার দায়িত্বশীল নেতাদের মাধ্যমে সাংগঠনিক বার্তা জানানো হয়েছে।

এখানে উলেস্নখ্য যে, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে জামায়াতও এই সরকারের অধীন গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিএনপি এই উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অন্যতম চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামী আন্দোলনও সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জামায়াতও শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিলো।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ১৫ এপ্রিল সোমবার ছিল ১৫০টি উপজেলায় মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। এবার সম্পূর্ণ অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। এতে চেয়ারম্যান পদে ৬৯৬ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭২৪ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৭১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।

তফসিল অনুযায়ী, প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র বাছাই ১৭ এপ্রিল। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল। আপিল নিষ্পত্তি ২১ এপ্রিল, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ ২৩ এপ্রিল, আর ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ৮ মে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে