শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণমিছিল কর্মসূচি

ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল দেশ

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ-ভাঙচুর, গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, ইটপাটকেল নিক্ষেপ হবিগঞ্জে যুবক নিহত আজ বিক্ষোভ, কাল থেকে অনির্দিষ্টকালের 'সর্বাত্মক অসহযোগ' আন্দোলনের ডাক
যাযাদি রিপোর্ট
  ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ -ফোকাস বাংলা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচি ঘিরে শুক্রবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ-ভাঙচুর, গুলি, টিয়ার শেল-সাউন্ড গ্রেনেড- ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জে পুলিশ-বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে একজন শ্রমিক নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক আহত এবং অন্তত ৫০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। চট্টগ্রামে পুলিশ বক্সসহ কয়েকটি স্থাপনা ভাঙচুর করেছেন বিক্ষোভকারীরা। এছাড়া আগুন দেওয়া হয়েছে হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। এদিকে শুক্রবার গণমিছিল শেষে আজ শনিবার পূর্বঘোষিত ৯ দফা দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও আগামীকাল রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের 'সর্বাত্মক অসহযোগ' আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। শুক্রবার সকাল থেকে শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, শিল্পী, চিকিৎসকরা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা গণমিছিলসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন।

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সামনে সকাল ১০টার দিকে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। শিক্ষার্থী হত্যার বিচারের দাবিতে তারা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেন। স্স্নোগানে স্স্নোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে চারপাশ।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাজ্জাদুর রহমান বলেন, 'কী দোষ ছিল আমার ভাই মুগ্ধের, কী দোষ ছিল ওই শিশু মেয়েটির, যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল? কীই-বা দোষে এতগুলো নিরীহ মানুষ মরল! কেন নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হলো। আমরা প্রতিটি হত্যার বিচার চাই।'

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমাবেশে অংশ নেন কলেজের অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক। তারাও অনেকে শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিচারের দাবিতে স্স্নোগান দেন। ফারজানা সুলতানা নামের একজন অভিভাবক বলেন, 'আমার মেয়ে কলেজে পড়ে। এখন বাসা থেকে বের হলেই আর মনে শান্তি পাই না। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকি। আমিও এ ধরনের অন্যায়ের বিচার চাই। তাই বৃষ্টি উপেক্ষা করেই মেয়ের সঙ্গে কর্মসূচিতে এসেছি।'

\হবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা গণমিছিল কর্মসূচির অংশ হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন একদল তরুণ-যুবক। কয়েক ঘণ্টা অবরোধের পর তারা বিকাল ৪টার পর মিছিল নিয়ে শাহবাগে যান। বিকাল সাড়ে ৪টায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। কাছাকাছি সময় ঢাকার ইসিবি চত্বরে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ করছেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের এসব অবস্থান থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যেসব হত্যাকান্ড ঘটেছে, সেগুলোর বিচার দাবিতে নানা স্স্নোগান দেওয়া হচ্ছে। আটক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তি দাবি করেও স্স্নোগান দিচ্ছেন তারা।

এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার পরে আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল নিয়ে তারা রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আবার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এ সময় মিছিলে থাকা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর গলায় পরিচয়পত্র ছিল।

সকালে বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত শিল্পী ও সাধারণ মানুষ আজ ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে শামিল হন। তারা নিহতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার এবং হত্যার দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবি করেন।

\হসেখানে নারী নেত্রী ফরিদা আখতার বলেন, শত শত নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা আর ঘটেনি। এর দায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।

\হবেসরকারি সংস্থা ব্রতী ও উত্তরসূরির কর্ণধার শারমিন মুরশিদ বলেন, 'এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আমাদের সাহসী হতে শিখিয়েছে। ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের এই আত্মদান যেন বৃথা না যায় সে কারণে সর্বস্তরের মানুষকে পথে নামতে হবে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।'

বাংলা মোটরে পরিকল্পনাবিদরাও মানববন্ধন করেছেন। তারা বলেছেন, সমাজে প্রতি পায়ে-পায়ে ভয়। কিন্তু এই শিক্ষার্থীরা কোনো ভয় পায় না। ওরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য পথে নেমেছে। আর কোনো শিক্ষার্থী যেন হয়রানি ও গুলির শিকার না হয়। যেসব জায়গায় এসব হত্যাকান্ড ঘটেছে, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয় মানববন্ধন থেকে।

সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সাংস্কৃতিক শিল্পীগোষ্ঠী উদীচী। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্য কয়েকটি সংগঠন। উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, 'আমরা আজ বিচিত্র এক সময়ে দাঁড়িয়ে। যখন আমরা হারিয়েছি আমাদের সন্তানদের, বন্ধুদের।' কোটা আন্দোলনের মতো একটি আন্দোলন সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতার দায়ে বীভৎস অবস্থায় চলে গেছে উলেস্নখ করে বদিউর রহমান বলেন, 'যা কিছু ঘটেছে এর দায় কেউ এড়াতে পারে না। এর দায় সরকারের ওপর বর্তায়।'

এ ছাড়া সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মেডিকেল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকরা বিক্ষোভ করেছেন। সকালে বাংলা মোটরে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সামনে বিক্ষুব্ধ 'কবি-লেখক সমাজ' ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। দুপুরে বায়তুল মোকাররম ও প্রেস ক্লাব থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে বিক্ষোভ করেন।

শুক্রবার বিকাল ৪টার পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকার মাটিকাটা এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে ইসিবি চত্বরে গিয়ে অবস্থান নেন কয়েকশ' শিক্ষার্থী। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা 'আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না', 'আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না', 'লেগেছে ভাই লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে', 'আমার শিক্ষক জেলে কেন, মুক্তি চাই'সহ নানা স্স্নোগান দেন। এ সময় ইসিবি চত্বর ও এর আশপাশে পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) বিপুল সংখ্যক সদস্যকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

বিমানবন্দর-দক্ষিণখান প্রতিনিধি জানান, রাজধানীর উত্তরায় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।

শুক্রবার বিকালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে মাইলস্টোন কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি সামনে রেখে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের জমজম টাওয়ারের সামনে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা মাইলস্টোন কলেজের সামনে অবস্থান নেয়।

বিকাল সোয়া চারটার পর আওয়ামী লীগের সমর্থকরা মাইলস্টোন কলেজের দিকে থাকা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ধাওয়া দেন। এ সময় পুলিশও শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয় এবং সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও হত্যার প্রতিবাদসহ পূর্বঘোষিত ৯ দফা দাবিতে আজ শনিবার সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও কাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য 'সর্বাত্মক অসহযোগ' আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুক্রবার রাতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার। সারা দেশের আপামর জনসাধারণকে অলিতে-গলিতে, পাড়ায় পাড়ায় সংগঠিত হয়ে কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে