রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

এ কেমন নিষ্ঠুরতা!

মুনতাহা হত্যায় গৃহশিক্ষিকাসহ ৪ জন আটক
কানাইঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি
  ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
এ কেমন নিষ্ঠুরতা!
মুনতাহা আক্তার জেরিন

ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিন ৩ নভেম্বর দুপুরে তাদের পাশের বাড়িতে খেলতে যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেও যখন জেরিন ঘরে ফিরছে না, তখন তার বাবা ছুটে যান ওই বাড়িতে। না পেয়ে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও খোঁজাখুঁজি করেন তারা। কিন্তু সন্ধান মেলেনি কোথাও। উপায় না পেয়ে বাবা শামীম আহমদ যান থানায়। করেন নিখোঁজের জিডি। এ নিয়ে খবর আসে গণমাধ্যমে। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। সন্ধান চেয়ে অনেকেই আবেগঘন পোস্ট দেন। অবশেষে আসে দুঃসংবাদ। রোববার ভোরে এক নারী মুনতাহার লাশ প্রতিবেশীর পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে দেখে ফেলেন স্থানীয়রা। মূলত হত্যা করে একটি ডোবায় কাঁদার মধ্যে পুঁতে রাখা হয়েছিল শিশুটির লাশ। সন্দেহভাজন এক তরুণী আটক হওয়ার পর তার মা বিষয়টি ভিন্ন খাতে নিতেই ডোবা থেকে লাশ তুলে পুকুরে ফেলতে চেয়েছিলেন। এ সময় লাশের গলায় রশি পেঁচানো ছিল। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায়। আটক হওয়া ওই নারীর নাম আলিফজান বিবি। তিনি একই বাড়ির মৃত ময়না মিয়ার স্ত্রী। তারা উপজেলার বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের বাসিন্দা।

এদিকে, এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন আলিফজান বিবির বসতঘর ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এর আগে কানাইঘাট থানা পুলিশ শনিবার গভীর রাতে আলিফজান বিবির মেয়ে নিখোঁজ মুনতাহার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শামীমা বেগম মার্জিয়াকে আটক করে। মার্জিয়াকে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসার পর পুলিশের ভয়ে আলিফজান বিবি বসতঘরের পাশে ডোবায় পুঁতে রাখা মুনতাহার লাশ ভোরে তুলে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের পুকুরে ফেলার চেষ্টা করছিলেন।

এ ঘটনায় কানাইঘাট থানা পুলিশ এখন পর্যন্ত মোট চারজনকে আটক করেছে। আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে তরুণী শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫) ছাড়া অন্য দুইজন হলেন- মৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুনুর রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫)। তারা সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে থানার

অফিসার ইনচার্জ আব্দুল আওয়াল জানিয়েছেন।

জানা যায়, গত ৩ নভেম্বর দুপুরবেলা শিশু মুনতাহা জেরিন তার বাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের বাড়ির শিশুদের সঙ্গে খেলতে যায়। ওইদিন বিকাল পর্যন্ত মুনতাহা বাড়িতে ফিরে না আসলে তাকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে বাবা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় মেয়ে নিখোঁজের জিডি করেন। এলাকার সবাই সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও মুনতাহার কোনো সন্ধান পাননি। নিখোঁজের সংবাদগণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সবার অপেক্ষা ছিল মুনতাহা জীবিত অবস্থায় বাবা-মা'র কোলে ফিরে আসবে। একপর্যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে ফিরে পেতে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ডাটাবেজ ধরে প্রযুক্তির আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর নিজ বসতবাড়ির আলিফজান বিবির বসতঘরের পাশে ডোবায় পুঁতে রাখা মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ জানান, মুনতাহার এক সময়ের গৃহ শিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু মার্জিয়ার খারাপ আচরণের কারণে তার কাছে মুনতাকে আর পড়তে দেয়নি পরিবারের সদস্যরা। এতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে মার্জিয়া। মুনতাহার বাবা-মা'র ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গত ৩ নভেম্বর মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া এবং তার মা আলিফজান বিবি তাদের বসতঘরে নিয়ে যায়। সেখানে মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে এবং গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। পরে লাশ বস্তাবন্দি করে ঘরের মধ্যে রাখা হয়। ওইদিন গভীর রাতে হত্যাকারীরা মুনতাহার লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে ডোবায় পুঁতে রাখে। একাধিকবার মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়াসহ তার পরিবারের কাছে মুনতাহা নিখোঁজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে একেক সময় একেক ধরনের কথা বলতে থাকে তারা। মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে গত শনিবার রাতে থানা পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়। মার্জিয়াকে থানায় নিয়ে আসার পর তার মা আলিফজান বিবি নিহত মুনতাহার পুঁতে রাখা লাশ তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে আলিফজান বিবিকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। পরে আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামিমা বেগম মার্জিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের মৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগমকে (৩০) রোববার দুপুরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত চারজনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ওসি আব্দুল আউয়াল।

এদিকে রোববার দুপুর ২টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান নিহত মুনতাহার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে শান্তনা দেন এবং হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান জানান, শিশু মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। মুনতাহার হত্যাকারী চারজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছি এবং এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের প্রত্যেককে দ্রম্নত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে পুলিশ সুপারের সঙ্গে ছিলেন- সিলেট জেলার এডিশনাল পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, কানাইঘাট সার্কেলের এএসপি অলক কান্তি শর্মা এবং থানার ওসি আব্দুল আউয়াল।

শিশু মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে নিয়ে আসলে সেখানে আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। উপস্থিত এলাকার শত শত লোকজন মুনতাহা হত্যাকান্ডের ঘাতকদের ফাঁসির দাবি জানান। রোববার বাদ আসর মুনতাহার লাশ বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে জানাজার নামাজ শেষে গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে