রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ

যাযাদি ডেস্ক
  ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকরা -ফাইল ছবি

বিদেশে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী পাঠানো কমে গেছে। বিশেষ করে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ থেকে ২০২৪ সালে রপ্তানির হার ক্রমেই কমেছে। বিশ্ব শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়লেও এর বিপরীতে স্বল্প দক্ষ ও আধা-দক্ষ কর্মী রপ্তানি বেড়েছে।

দক্ষতা উন্নয়নে পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও নীতিমালার অভাবে এ প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ফলে হারাতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা। প্রবাসী শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

1

সর্বশেষ ২০২৪ সালে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে যান ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা দুই লাখ ১৪ হাজার ৪৪ জন, যা মোট শ্রমবাজারের ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। পেশাজীবী হিসেবে পাড়ি জমিয়েছেন ৪১ হাজার ৬২১ জন, যা মোট শ্রমবাজারের চার দশমিক ৫৯ শতাংশ। স্বল্প দক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে গেছেন চার লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন বা ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ মোট জনশক্তি রপ্তানির অর্ধেকের বেশি স্বল্প দক্ষ হিসেবে বিদেশে গেছেন। এছাড়া আধা-দক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে গেছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ১২৮ জন বা ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চের (রামরু) এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। রামরু জানিয়েছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরো (বিএমইটি) থেকে এসব তথ্য নিয়ে তারা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন।

রামরুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। অন্যদিকে একই সময়ে স্বল্প দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির সংখ্যা আগের চার বছরের চেয়ে বেড়েছে।

বিএমইটি দক্ষতার রকমফের অনুযায়ী অভিবাসী কর্মীদের চার ভাগে ভাগ করে। এগুলো হলো পেশাজীবী, দক্ষ, আধা-দক্ষ ও স্বল্প দক্ষ কর্মী। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, শিক্ষক, হিসাবরক্ষক, কম্পিউটার অপারেটর, ফার্মাসিস্ট, নার্স, ফোরম্যান, ডিপেস্নামা ইঞ্জিনিয়ার, প্যারামেডিক ও বিক্রয়কর্মীরা বিবেচিত হন পেশাজীবী হিসেবে।

মেকানিক, ওয়েল্ডার, ওস্তাগার, ইলেট্রিশিয়ান, রংমিস্ত্রি, পাচক, ড্রাইভার, পস্নাম্বার, গার্মেন্ট শ্রমিক এবং সনদপ্রাপ্ত কেয়ারগিভাররা দক্ষ কর্মী হিসেবে বিবেচিত হন। কৃষক ও মালি এবং গার্মেন্টস ও দোকানপাটে সহায়ক হিসেবে কর্মরতরা আধা-দক্ষ কর্মী হিসেবে বিবেচিত হন। পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও গৃহকর্মীদের বিবেচনা করা হয় স্বল্প দক্ষ কর্মী হিসেবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশের শ্রমবাজারে স্বল্প দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অন্যদিকে দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি ক্রমেই কমছে।

রামরুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। অন্যদিকে একই সময়ে স্বল্প দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির সংখ্যা আগের চার বছরের চেয়ে বেড়েছে।

২০২১ সালে বিদেশে যাওয়া মোট জনশক্তির ২১ শতাংশ ছিল দক্ষ, ৭৫ দশমিক ২৪ শতাংশ স্বল্প দক্ষ, তিন দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল আধা-দক্ষ ও শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ পেশাজীবী।

২০২২ সালে দক্ষ জনশক্তি গেছেন ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, স্বল্প দক্ষ ৭৩ দশমিক ০৮ শতাংশ, আধা-দক্ষ তিন দশমিক ৮৫ শতাংশ ও পেশাজীবী শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ।

২০২৩ সালে দক্ষ জনশক্তির সংখ্যা ২৪ শতাংশ। এ বছর স্বল্প দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা আগের চেয়ে কম ছিল, প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে পেশাজীবী ও আধা-দক্ষ কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়ে। পেশাজীবীর সংখ্যা ছিল চার দশমিক ১৪ শতাংশ ও আধা-দক্ষ কর্মীর সংখ্যা ছিল ২১ দশমিক ০১ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত ছিল ২০২৪ সালে। গত বছর ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ দক্ষ, ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ আধা-দক্ষ, ৫৪ দশমিক ২৩ শতাংশ স্বল্প দক্ষ ও চার দশমিক ৫৯ শতাংশ পেশাজীবী কাজের জন্য বিদেশে গেছেন।

বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ কোভিডের সময়ে জনশক্তি রপ্তানির তথ্য নেই। তবে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানিতে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল।

২০১৬ সালে মোট জনশক্তি রপ্তানির ৪২ দশমিক ০৮ শতাংশ দক্ষ হিসেবে গেছেন। স্বল্প দক্ষ হিসেবে গেছেন ৪০ দশমিক ০৮ শতাংশ, আধা-দক্ষ ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, পেশাজীবী শূন্য দশমিক ৬১ ও অন্য ১ দশমিক ৪০ শতাংশ।

২০১৭ সালে পাঠানো জনশক্তির ৪৩ দশমিক ০৭ শতাংশ ছিলেন দক্ষ। এই বছরে স্বল্প দক্ষ হিসেবে ৩৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ, আধা-দক্ষ ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ, পেশাজীবী শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ ও অন্যান্য হিসেবে ১ দশমিক ২২ শতাংশ কর্মী গেছেন।

২০১৮ সালে দক্ষ হিসেবে গেছেন ৪৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, স্বল্প দক্ষ ৩৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, আধা-দক্ষ ১৬ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেশাজীবী শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ ও অন্যান্য ১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

২০১৯ সালে দক্ষ কর্মী গেছেন ৪৪ শতাংশ, স্বল্প দক্ষ ৪১ শতাংশ, আধা-দক্ষ ১৪ শতাংশ ও পেশাজীবী ১ শতাংশ।

দক্ষ জনশক্তি উৎপাদনে সরকারের নজর কম

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা তিন বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ করে শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। তাদের অধিকাংশই স্বল্প দক্ষ বা অদক্ষ হয়ে যাচ্ছেন। অথচ এই খাতে দক্ষ জনশক্তি উৎপাদনে সরকারের নজর কম। আবার এদের মধ্যে নির্দিষ্ট অংশ প্রতারণার শিকার হয়ে ফেরতও আসছেন। অধিক পরিমাণে লোক পাঠানোর চেয়ে দক্ষ শ্রমিক রপ্তানিতে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে শ্রমবাজারগুলো শক্তিশালী হবে।

এছাড়া দক্ষতা উন্নয়ন ও উচ্চমানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করে বিদেশে পাঠালে ভবিষ্যতে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও চাপের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রামরু জানিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শ্রমবাজারের যে চিত্র তা থেকে প্রতীয়মান যে পেশাজীবী কর্মীদের সংখ্যা সবসময়ই সামান্য। বাংলাদেশ মূলত অংশগ্রহণ করে আধা-দক্ষ এবং স্বল্প দক্ষ শ্রমবাজারে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পেশাজীবীদের অংশ প্রায় শূন্যের কোঠায় ছিল। দক্ষ কর্মী প্রেরণে বিএমইটির প্রশিক্ষণের গুণগত মান, স্বীকৃতি ও প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাব, জনবল সংকট এবং রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অনীহা দায়ী করছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা এই সংস্থাটি।

রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, 'দক্ষ শ্রমিক তৈরি না করে তো দক্ষ শ্রমিক পাঠানো সম্ভব নয়। আমাদের যে ভিসাগুলো আসে সেগুলো অদক্ষ শ্রমিকের ভিসা। আমাদের শ্রমিকদের যে দক্ষতা আছে, সেটা বাইরেও স্বীকৃত নয়। বাজারের যে চাহিদা আছে, সেটা আমাদের শ্রমিকদের সঙ্গে ম্যাচ করে না। আমাদের ট্রেনিং সেন্টারে যে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে, সে দক্ষতা দিয়ে বিদেশে কাজ পাচ্ছেন না। এজন্য সরকারকে দক্ষ লোকবল তৈরি করতে হবে। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সিকে দক্ষ শ্রমিকদের কাজে আনার জন্য জোর দিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তারাও টাকা খরচ করে দক্ষতা অর্জন করতে চান না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ যেতে চান, কিন্তু ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ট্রেনিং নিতে চান না।'

দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে অবদান রাখছে না ট্রেনিং সেন্টার

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, 'আমাদের ট্রেনিং সেন্টারগুলো (টিটিসি) মান্ধাতার আমলের। এগুলো সব পলিটিক্যাল। মন্ত্রী-সচিবরা নিজ এলাকায় বানিয়েছেন। সেখানে পর্যাপ্ত শিখন ব্যবস্থা ও দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে। যেসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেটাও ফলপ্রসূ হয় না। টিটিসিগুলো বাইরের শ্রমবাজার অনুযায়ী যুগোপযোগী কাজ শেখাতে পারে না। এগুলো আমাদের দেশের কাজের জন্যই দক্ষ করে তুলতে পারে না, বাইরের দেশে তো দূরের কথা। পর্যালোচনা করে দেখা যাবে গত কয়েক বছরে শুধু ভবনই উঠেছে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি হয়নি। ভালো প্রশিক্ষকও তৈরি হয়নি। অথচ সরকার চাইলে বিদেশি শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমিক তৈরি করতে পারে। প্রয়োজনে পেশাদার প্রশিক্ষক আনতে পারে।'

মালয়েশিয়া প্রবাসীদের পাসপোর্ট ভোগান্তি চরমে

রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, 'আমাদের যে ট্রেনিং সেন্টার আছে, সেখানে তিন মাসের ট্রেনিং নিয়ে কেউ দক্ষ হয়ে উঠতে পারে না। ন্যূনতম ছয় মাসের ট্রেনিং দরকার। এছাড়া ট্রেনিং সেন্টারেও লোকবল সংকট। পর্যাপ্ত বরাদ্দও নেই টিটিসির জন্য।'

এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশিক্ষণ) শাহ্‌ আবদুল তারিক বলেন, 'বিদেশ থেকে যে ডিমান্ডগুলো আসছে, সে অনুযায়ী শ্রমিক তো যাচ্ছে। আমাদের টিটিসি কাজ করে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আরও ভালো করবে। তিন মাসের যে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, এখন সেটা ছয় মাস করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা যে পরিমাণ দক্ষ লোকবল তৈরি করছি, সবাইকে তো পাঠাতে পারছি না। অনেক সময় ডিমান্ডই থাকে না। আমাদের কিন্তু দক্ষ শ্রমিক আছে, কিন্তু ডিমান্ড না থাকলে তো এসব শ্রমিক যেতে পারবে না।'

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, 'দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা না থাকলে তো আমরা জোর করে পাঠাতে পারব না। আমরা কখনো বিদেশি নিয়োগ কর্তাদের চাহিদা ফেইল করিনি। তারা যেমন চাহিদা দেয়, আমরা সে অনুযায়ী পাঠাই। লেবার চাইলে লেবার। টেকনিশিয়ান চাইলে টেকনিশিয়ান পাঠাই। প্রতিটা দেশ তাদের পলিসি অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ থেকে লোক নেয়। তারা ব্যালেন্স রাখে। তারা কোন দেশ থেকে কোন ক্যাটাগরির লোক নেবে তারাই ঠিক করে।'

দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে যা প্রয়োজন

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা শ্রমিকদের জন্য অনেক কারিকুলাম তৈরি করেছে সেক্টরভিত্তিক, ভাষা থেকে শুরু করে কাজের আওতা পর্যন্ত। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন নেই। বিদেশের কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। শ্রমবাজার নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপভিত্তিক গবেষণা করতে হবে। ওইসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বেশি শ্রমিক না পাঠিয়ে অল্প শ্রমিক পাঠিয়ে তাদের বেতন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন শ্রমবাজার খুলতে হবে। কর্মীবান্ধব চুক্তি করতে হবে। প্রতিটা কর্মীকে বৈধ ভিসায় পাঠাতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে