আমনের ভরা মৌসুমে বাজারে চালের ঘাটতি নেই। সরকারের চালের মজুত, স্থানীয় উৎপাদন ও সংগ্রহও স্বাভাবিক। অথচ অবৈধ মজুতদারির কারণে চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা অপকটে তা স্বীকার করলেও অবৈধ মজুতদারিতে লাগাম না টেনে চাল আমদানির দিকে ঝুঁকছে। এতে চালের বাজারের অস্থিরতা দূর করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অবৈধ মজুতদারি বন্ধ না করে আমদানি যতই বাড়ানো হোক না কেন, তাতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বরং এতে হিতেবিপরীত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে দীর্ঘ মেয়াদে আমদানির ওপর নির্ভরশীল হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব অদূর ভবিষ্যতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর পড়বে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ধান-চালের অবৈধ মজুতের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। তারা গুদামের সক্ষমতা যাচাই না করেই এক ব্যক্তিকে একাধিক ফুড গ্রেইন লাইসেন্স দিচ্ছেন। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে চালের মজুত গড়ে তুলছেন। অথচ অবৈধ মজুতের দায়ে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের জরিমানা হলেও সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় খাদ্য বিভাগ আড়ত, হাটবাজার, পাইকারি দোকান, রাইসমিল এবং অনির্ধারিত গুদামে অভিযান পরিচালনা করেছে। এ সময় বিপুল অংকের অর্থ জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু যেসব জেলায় অবৈধ মজুত পাওয়া গেছে, ওই এলাকার বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা (আরসি-ফুড), জেলা খাদ্য কর্মকর্তা (ডিসি ফুড) এবং উপজেলা খাদ্য
নিয়ন্ত্রকের (টিএফসি) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ তাদের দায়িত্ব পালনে অপরিপক্বতা দেখানোর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিবছর চালের বাজার নিয়ে এক ধরনের খেলায় মেতে ওঠে ব্যবসায়ীরা। এতে বাজারদর বেড়ে গিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়। এর পেছনে মাঠপর্যায়ে কর্মরত খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। বাজার তদারকি এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দেখা গেছে এক ব্যক্তিকে একাধিক ফুড গ্রেইন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের লাইসেন্সের অনুকূলে অবৈধ মজুত গড়ে তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ বৈধ লাইসেন্সের আওতায় অবৈধ মজুত। লাইসেন্সের শর্তাদি প্রতিপালন করছে কি না, তা যথাযথভাবে মনিটর করছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
কোন ব্যবসায়ী কত মেট্রিক টন ধান, কতদিনের জন্য, কোন গুদামে, কোন মিলে ভাঙানোর জন্য মজুত করতে পারবেন, তা ফুড গ্রেইন লাইসেন্সের শর্তে বলা থাকে। কোনো মিলের বিপরীতে যে পরিমাণ ধান মজুত দেখানো হয়, সেই মিলের হাস্কিং ক্যাপাসিটি কত, তাও সরেজমিন পরিদর্শন করে লাইসেন্স দেওয়ার বিধান রয়েছে। এমনকি ওই মিলের মাসিক বিদু্যৎ বিল পরীক্ষা করে ধারণা নিতে হবে কত টাকা বিল আসে। মিল চালু করে দেখতে হবে সেখানে কত পরিমাণ ধান একদিনে ভাঙানো সম্ভব। ধান সংরক্ষণের জন্য গুদামের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, সেখানে প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো গুদাম আছে কি না। সার্বিক বিষয় নিশ্চিত হয়ে তারপর ফুড গ্রেইন লাইসেন্স ইসু্য করার কথা।
এরপর যদি কেউ লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধ মজুত গড়ে তোলে, তার বা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আরসি-ফুড, ডিসি-ফুড এবং টিএফসির। সে কাজটিও তারা সঠিকভাবে করছেন না। এ সুযোগে ফন্দিবাজ ব্যবসায়ীরা অবৈধ মজুত গড়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। এতে বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। এরপরও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোনো পদক্ষেপ নেন না। বেশি হইচই শুরু হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
এদিকে অবৈধ মজুতের কারণে ধান-চালের দাম বৃদ্ধির কথা সরকারের নীতি-নির্ধারক, মিল মালিক ও আড়াতদারসহ সবাই নিঃসংকোচে স্বীকার করলেও সবাই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় সারছেন।
মিল মালিকদের অভিযোগ, কৃষকের ধান এখন লাইসেন্সবিহীন মজুতদারদের কাছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সময় মিল মালিকদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে তারা বেশি দামে ধান কিনে মজুত করেছেন। ধানের বিপুল মজুত গড়ে এখন তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। মিল চালু রাখতে মিল মালিকরাও তাদের কাছে জিম্মি। দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, নওগাঁসহ যেসব জেলায় ধান বেশি উৎপাদন হয় ওইসব এলাকায় শত শত অবৈধ গুদাম রয়েছে। বিশাল আকৃতির ওইসব গোডাউনে হাজার হাজার বস্তা ধান কিনে অবৈধভাবে মজুত করে রাখা হয়েছে। এসব গুদামে নিয়মিত অভিযান চালানো হলে বাজারে ধান-চালের দাম কমে আসবে। বিদেশ থেকে চাল আমদানির তেমন প্রয়োজন হবে না বলেও মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যবসায়ী নীতিমালাকে তোয়াক্কা না করে আজকাল অনেকেই স্টক বিজনেসের নামে ধানসহ এসব ভোগ্যপণ্য মজুত করছেন। বর্তমানে মিল মালিকদের চাইতে স্টক ব্যবসায়ীদের গুদামে বেশি ধান আছে। মৌসুমের শুরুতে বেশি দামে কিনে মজুত করছেন। পরে মিল মালিকরাই এসব ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে আরও বেশি দামে কিনছেন। তার ভাষ্য, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বৈধ-অবৈধ গুদামে নিয়মিত অভিযান চালানো জরুরি। একই সঙ্গে অবৈধ মজুতে সহায়তাকারী খাদ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।
এদিকে ছোট ও মাঝারি মিলারদের অভিযোগ, দেশের বৃহত্তর রাইস মিল মালিকরা আমন ধান বাজারে নামার সঙ্গে সঙ্গে শত শত ট্রাক ধান বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে বাজারে ধানের সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও অবৈধ মজুতদাররাও ধান মজুতের মাধ্যমে বাজারে ধানের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। এর ফলে বাজারে চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। এছাড়া বর্তমান আবহাওয়ার কারণে সূর্যের তাপ না থাকায় চাতাল মালিকরা চাল শুকাতে না পারায় দাম বাড়তে পারে মনে করেন তারা।
যদিও বড় মিলারদের অনেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, আড়তদারির নাম করে বিনা লাইসেন্সে কেউ কেউ হাজার হাজার মণ ধান স্টক করছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে অবৈধ মজুত হু হু করে বাড়ছে, যা চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক সমিতির নেতারা জানান, চট্টগ্রামে বড় কোনো চালকল নেই। এখানে যা আছে তার বেশির ভাগই ছোট ছোট চালকল। এসব চালকল চাল মজুত করে বাজারে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে না। এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বড় করপোরেট হাউজগুলো। তারা চালকল মালিক বা মিলারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল কিনে নিচ্ছে। এরপর তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের মোড়ক দিয়ে বাজারজাত করছে। পাশাপাশি এসব চাল বাজারে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে। একটি করপোরেট হাউজ একশ' বা তারও বেশি চালকলের সব চাল একসঙ্গে কিনে নিচ্ছে। দেশের চার-পাঁচটি করপোরেট হাউজ এভাবে সিংহভাগ চালকল থেকে একাই চাল কিনে নেওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পড়ছেন বিপাকে। করপোরেট হউজগুলোর সঙ্গে টিকতে পারছেন না তারা। এ কারণে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে শুধু বড় চালকল মালিক, মজুতদার ও করপোরেট হাউজগুলোর কারণেই ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে- এমনটা মানতে রাজি হন বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাদের ভাষ্য, এর নেপথ্যে সরকারের তথ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, মজুত পরিস্থিতির নাজুকতা, বাজার পর্যবেক্ষণের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফলনে ভাটা, সঠিক সময়ে আমদানির সিদ্ধান্তে যেতে না পারার বিষয়গুলোও ভূমিকা রাখছে। এছাড়া মৌসুমি ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলেন তারা।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সরকার কোনো বছরই খাদ্য মজুতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এ সুযোগ নিয়েছেন ওই বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে ধানও কিনছেন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তারাই মূলত ঠিক করে দেন ধান চালের বাজারদর কী হবে, কত হবে।
অন্যদিকে মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, মজুতের জন্য খাদ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেওয়া অধিকাংশ বৈধ গুদামে নির্ধারিত পরিমাণের কয়েক গুণ বেশি ধান-চাল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য মজুতের জন্য সর্বোচ্চ যে সময় নির্ধারিত, সেটিও মানা হচ্ছে না। যা মজুতদারি আইনে অবৈধ। এ অপরাধে ফৌজদারি আইনে মামলা এবং জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির সুযোগে মজুতকারী চক্র প্রায়ই লাখ লাখ টন ধান-চাল অবৈধভাবে মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে।
এছাড়া সারাদেশে বিপুল সংখ্যক অবৈধ মজুতদার রয়েছেন। তাদের গুদামে কী পরিমাণ ধান-চাল মজুত রয়েছে সে তথ্য দূরে থাক, এ ধরনের অবৈধ মজুতদারের সংখ্যা কত সে পরিসংখ্যানই নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে। অবৈধ মজুতদারদের তালিকা তৈরির জন্য বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
এদিকে মজুতদারির কারণে ভরা মৌসুমে অযৌক্তিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধির কথা খোদ বাণিজ্য উপদেষ্টাও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাজারে চালের ঘাটতি নেই। সরকারের চালের মজুত, স্থানীয় উৎপাদন ও সংগ্রহে ঘাটতি নেই। আমনের ভরা মৌসুম চলছে; এখন চালের দাম বেড়ে যাওয়ার যৌক্তিক কারণ নেই। এটা সাময়িক মজুতদারির কারণে হচ্ছে।
চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সরকার আমদানি উদারীকরণের নীতিতে যাচ্ছে বলে জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, 'আমদানি উদার করতে আমরা গভর্নর, খাদ্য উপদেষ্টা, টিসিবি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতিতে আপাতত আমদানিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'