বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি

আজ থেকেই কার্যকর
যাযাদি ডেস্ক
  ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি
অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি

ইসরাইলি আগ্রাসনের ৪৬৯ দিন পর মুক্তির স্বাদ পেতে যাচ্ছে গাজাবাসী। ইসরাইলের সরকার গাজা যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তি অনুমোদন করায় আজ রোববার সকাল থেকেই এটি কার্যকরের পথ তৈরি হয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, শুক্রবার ৬ ঘণ্টার আলোচনার পর নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা এই চুক্তি অনুমোদন করে। দু'জন কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রী এতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, এই চুক্তি যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। এদিকে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে হওয়া গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি আজ স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন। সোয়া এক বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনে যে কয়েকটি দেশ মধ্যস্থতা করেছিল, কাতার তাদের অন্যতম। অন্যদিকে, যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব অনুমোদন হওয়ায় এ অঞ্চলে 'টেকসই শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে' বলে মত দিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা। সূত্র:বিবিসি বাংলা ও আল-জাজিরা

বিবিসি জানিয়েছে, মধ্যস্থতাকারী কাতার, যুক্তরাষ্ট্র এবং মিসর চুক্তিটি ঘোষণা করার দুই দিন পর ইসরাইল ও হামাস চুক্তির শর্ত চূড়ান্ত করে। প্রথম পর্যায়ে, হামাসের কাছে থাকা ৩৩ জন ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। এর বিনিময়ে ইসরাইল কয়েকশ' ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। এ সময় ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরে আসবে এবং বাস্তুচু্যত ফিলিস্তিনিরা বাড়ি ফেরার সুযোগ পাবেন। প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।

1

দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হবে। তৃতীয় ধাপে গাজার পুনর্গঠন এবং জিম্মিদের দেহাবশেষ ফেরত দেওয়া হবে।

কাতারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের মধ্যে নারী, শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিরা থাকবেন।

চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় বিভাজন দেখা দিয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভীর এই চুক্তিকে 'ভয়ানক' বলে উলেস্নখ করেছেন। তিনি বলেন, যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের মুক্তি দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার দল চুক্তি অনুমোদিত হলে সরকার থেকে বেরিয়ে যাবে বলে হুমকি দেয়। অপরদিকে, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচ বলেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষে যুদ্ধ পুনরায় শুরু না হলে তার দলও সরকার ত্যাগ করবে।

হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে গাজায় ৪৬ হাজার ৮৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন এবং খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মিসরের রাজধানী কায়রোতে একটি যৌথ কার্যক্রম কক্ষ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা থাকবেন।

কী আছে এই চুক্তিতে

দীর্ঘ আলোচনার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং হামাস উভয়েই চুক্তির বিস্তারিত চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর চুক্তি অনুমোদনের সংবাদ আসে। অবশ্য এর দুদিন আগে মধ্যস্থতাকারী কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিশর যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছিল।

চুক্তি অনুযায়ী হামাসের হাতে থাকা ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে। চুক্তির প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই বন্দি বিনিময় হবে। একই সঙ্গে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে এবং বাস্তুচু্যত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘরে ফেরার অনুমতি পাবে। পাশাপাশি ত্রাণবাহী ট্রাকগুলোকে প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

দ্বিতীয় ধাপে হামাসের হাতে থাকা বাকী জিম্মিরা মুক্তি পাবে এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হবে। এর মাধ্যমে 'টেকসই শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে'। আর তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে গাজা পুনর্গঠন হবে- যা শেষ করতে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। একই সঙ্গে মৃত ইসরাইলি জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে।

কাতার জানিয়েছে প্রথম ধাপে যেসব জিম্মি মুক্তি পাবেন তার মধ্যে থাকবেন 'বেসামরিক নারী, নারী সেনা, শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ ও আহত বেসামরিক নাগরিকরা'

ইসরাইল বলছে, যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনে তারা তিন জন জিম্মির মুক্তি আশা করছে। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে ছয় সপ্তাহ ধরে ছোট ছোট দলে জিম্মিরা মুক্তি পাবে।

ইসরাইলের ভূখন্ডে প্রবেশ করে ২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর ১২শ' ব্যক্তিকে হত্যা ও ২৫১ জনকে জিম্মি করার জবাবে হামাসকে ধ্বংস করতে সামরিক অভিযান চালাচ্ছিল দেশটি। সংগঠনটিকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আরও কিছু দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৮৭০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। আরও প্রায় ২৩ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারা হয়েছেন। সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া খাদ্য, জ্বালানি, ঔষধ ও আশ্রয়ের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।

ইসরাইল বলছে, হামাসের হাতে এখনো ৯৪ জন জিম্মি আছে। এর মধ্যে ৩৪ জন মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর বাইরে যুদ্ধের আগে চারজন ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে দু'জন মৃত।

চুক্তির বিষয়ে ইসরাইলি সরকারে ভোটের আগে সংস্কৃতি মন্ত্রী মিকি জোহার বলেন: 'এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমরা সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ আমাদের কাছে সব শিশু ও নারী ও পুরুষকে ঘরে ফিরিয়ে আনাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি ভবিষ্যতে গাজায় আমাদের কাজ শেষ করতে আমরা সক্ষম হবো।'

তবে ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-জিভির বলেছেন চুক্তির বিস্তারিত থেকে তিনি আতঙ্কিত কারণ এতে জিম্মিদের বিনিময়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। তিনি এর বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার জন্য মন্ত্রীদের আহবান জানিয়েছিলেন।

বৃহস্পতিবার তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে চুক্তিটি অনুমোদিত হলে তার দল সরকার থেকে বেরিয়ে যাবে। তবে তিনি বলেছেন, যে পার্লামেন্টে সরকারের পতন ঘটাবেন না এবং 'হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আবারো পূর্ণ মাত্রায় শুরু হলে' তিনি সরকারে ফিরে আসবেন।

অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচ বলেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের পরেই আবার যুদ্ধ শুরু না হলে তার দল রিলিজিয়াস জায়ানিজম পার্টিও সরকার থেকে বেরিয়ে যাবে।

তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি কিছু জিম্মি পরিবারেও বিভক্তি ও উদ্বেগ তৈরি করেছে। তাদের ভয় হলো প্রথম ধাপের পর তাদের স্বজনদের গাজায় পরিত্যাগ করা হতে পারে। তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

'৪৬৯ দিন ধরে আমাদের স্বজনেরা জিম্মি অবস্থায় আছে এবং এখন শেষ পর্যন্ত একটি আশা তৈরি হলো', বলছিলেন এইনাভ যানগৌকার। তার ২৫ বছর বয়সী ছেলেও অপহরণ করা হয়েছিল। 'যুদ্ধ শেষ করতে ও সবাইকে ফিরিয়ে আনতে এই চুক্তি শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করা উচিত। যুদ্ধ শেষ করা, সবাইকে ফেরানো এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই ইসরায়েলের স্বার্থ।

শুক্রবার ইসরাইলের বিচার মন্ত্রণালয় ৯৫ ফিলিস্তিনি বন্দির তালিকা প্রকাশ করে। জিম্মিদের বিনিময়ে তারা মুক্তি পাবেন। এর মধ্যে ৬৯ জন নারী, ১৬ পুরুষ ও দশটি শিশু আছে বলে এএফপি জানিয়েছে। শুক্রবার কায়রোতে চুক্তি বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে বৈঠক হয়েছে বলে মিশরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা জানান প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে মিশর, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জয়েন্ট অপারেশন রুম গঠনের বিষয়টিও আছে।

মিশরের রাষ্ট্রায়ত্ত আল-কাহেরা নিউজ টিভি জানিয়েছে যুদ্ধবিরতির সময় প্রতিদিন ছয়শো ত্রাণবাহী লরি গাজায় প্রবেশ করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাজা প্রতিনিধি জানিয়েছে, এটি আরও বাড়তে পারে যদি মিশরের সাথে রাফাহ ক্রসিংসহ অন্য ক্রসিংগুলো খুলে দেয়া হয়।

সংস্থাটি আগে থেকে তৈরি কিছু হাসপাতালও গাজায় সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে। গাজায় অর্ধের বেশি হাসপাতাল অকার্যকর হয়ে গেছে। আর বাকীগুলো আংশিক কার্যকর আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে