সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২
সীমিত হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা

কমছে উৎপাদন, বাড়ছে ক্ষতি

মূল্যস্ফীতির উলস্নম্ফনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সেবা গ্রহণের প্রবণতা কমছে। এতে শিল্প ও সেবা খাতে চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। নিম্নমুখী এ প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কমছে উৎপাদন, বাড়ছে ক্ষতি
কমছে উৎপাদন, বাড়ছে ক্ষতি

এক বছরের বেশি সময় ধরেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির উলস্নম্ফন ঘটেছে। কখনো খাদ্যে, কখনো খাদ্য বহির্ভূত খাতে, কখনো আবার সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে দুই অংকের ঘর। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে শতাধিক পণ্য ও সেবায় আমদানি, ?উৎপাদন, সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক ও কর বাড়িয়েছে সরকার। এতে শুধু ওই পণ্যগুলোতেই নয়, অন্যান্য পণ্যের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সেবা গ্রহণের প্রবণতা কমে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পণ্যের মূল্য বাড়লে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাওয়ায় নতুন করে চাহিদা আরও কমবে- এটাই স্বাভাবিক। এতে শিল্পের উৎপাদনও কমবে, উৎপাদক বা ব্যবসায়ীরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের শিল্পখাতে বড় ধরনের ধস নামবে। দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চাহিদা কমায় এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানার মালিকরা তাদের নিয়মিত উৎপাদন বেশখানিকটা কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। সেবা খাতেও নড়বড়ে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রান্তিক জিডিপির পরিসংখ্যান চিত্রে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিবিএসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এই বড় দুই খাতের প্রবৃদ্ধি উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় দেশের সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অক্টোবর-ডিসেম্বরে সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমেছে, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ১০ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ ছিল।

অথচ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ।

শিল্পের মতো সেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি উলেস্নখযোগ্য হারে কমেছে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের ৬ দশমিক ৬২ শতাংশের চেয়ে অর্ধেকের কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ চলমান বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন কমেছে তেমনি রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি কম ছিল। এ ছাড়া ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগে স্থবিরতা আসে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসে সেবা খাতেও চাহিদা কমেছে। সব মিলিয়ে শিল্প ও সেবা খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সেবা গ্রহণের প্রবণতা কমে গেছে। একই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এমনকি মেশিনারিজ আমদানিতেও ব্যাঘাত ঘটেছে। পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্দশা। সঠিক জায়গায় ঋণ না দিয়ে পাচারকারীদের ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যারা সৎভাবে কাজ করে সম্পদ বানাতে চায় তারা বিনিয়োগ করতে পারেনি। এর ফলে বিনিয়োগ কম হয়েছে। কর্মসংস্থান বাড়েনি। আর যারা অসৎ তারাই ঋণ পেয়েছে। তারা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে অর্থপাচার করেছে। এর ফলে দেশ উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঠিক করার পাশাপাশি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এদিকে চাহিদা কমায় শিল্পকারখানাগুলো তাদের উৎপাদন কতটা কমিয়েছে এবং এতে তাদের ক্ষতির পরিমাণ কতটা বেড়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এটি যে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে তা তথ্য অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অবকাঠামো তথা নির্মাণ খাতের কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন উপকরণের চাহিদা কমে গেছে। ফলে দেশের বাজারে এসব পণ্যের উৎপাদন ও দাম- দু'টিই কমেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রডের দাম গত এক বছরে প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। এ পরিস্থিতিতে লোকসান পোষাতে না পেরে বেশিকিছু শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।

ব্যবসায়ী ও উৎপাদকেরা বলছেন, নির্মাণ খাতের প্রধান উপকরণ রডের দাম গত বছর লাখ টাকা ছাড়িয়েছিল। এই বছরের আগস্টে সরকারের পটপরিবর্তনে পরপর অবকাঠামো খাতে ধীরগতি দেখা দেয়। তাতে কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা।

রডের মতো চাহিদা কমছে নির্মাণের আরেক বড় উপকরণ সিমেন্টের। তাতে অবশ্য সিমেন্টের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। উদ্যোক্তাদের দাবি রড ও সিমেন্ট এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে আর কমার সুযোগ নেই। কারণ, নতুন করে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবং বাড়তি সুদহারের কারণে উৎপাদন খরচ আরেক দফা বাড়বে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের নির্মাণ খাতে গত কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মূলত সরকারি প্রকল্পের ওপর ভর করে। নির্মাণসামগ্রীর মোট চাহিদার অন্তত ৬০ শতাংশ বিক্রি হতো সরকারি খাতে। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজে ধীরগতি দেখা দেয়। চলমান প্রকল্পগুলোতে স্থবিরতা শুরু হয়। এটিই চাহিদা কমার সবচেয়ে বড় কারণ।

ইস্পাত খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তারা অবশ্য বলছেন, মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এসে এখন চাহিদা সামান্য বেড়েছে। মূলত ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর ভর করে এই চাহিদা বেড়েছে। তবে সব মিলিয়ে নির্মাণ খাতের জন্য এই মৌসুম ভালো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) সভাপতি ও জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নির্মাণ উপকরণের চাহিদা সবচেয়ে বেশি কমেছে সরকারি ও আবাসন কোম্পানিগুলোর প্রকল্পে। ব্যক্তি খাতে চাহিদা সেভাবে প্রভাব পড়েনি। তবে বছরের শেষ দিকে এখন চাহিদা সামান্য বাড়লেও তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।

শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী কোম্পানি বিএসআরএম গ্রম্নপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত বলেন, বাজারে এখন উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে রড বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে চলেছে। যেমন ডলারের দর ১২২ টাকা থেকে বেড়ে ১২৬-১২৭ টাকায় উন্নীত হয়েছে। আবার সুদের হারও বেড়েছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় রডের দাম আর কমার সুযোগ নেই।

খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাই থেকে স্থানীয় ইস্পাত কোম্পানিগুলোর মোট বিক্রি প্রতি মাসে দেড় লাখ টনে নেমে এসেছে, যা আগে প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টনের বেশি ছিল। মজুত থাকা পণ্য খালাসে ইস্পাত কোম্পানিগুলো পরিচালন ব্যয় মেটাতে গত মাসে টনপ্রতি প্রায় ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা দাম কমিয়েছে।

এদিকে চাহিদা কমায় রডের কাঁচামালের আমদানিতে প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে নির্মাণ মৌসুম শুরু হয়, যা চলে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময়কে বিবেচনায় রেখেই সাধারণত উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানি বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এবার নির্মাণ মৌসুম শুরু হওয়ার পর চাহিদা পতনের কারণে এখন আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার কমছে।

এদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন, বিক্রিতে মন্দা এবং উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকায় এক সময়ের স্বয়ংসম্পূর্ণ কাগজ শিল্প এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে। খরচ পোষাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক পেপার মিল। এতে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন অনেকে, একইসঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগের। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে পেপারের চাহিদা ৯ লাখ টন হলেও উৎপাদন প্রায় ১৫ লাখ টন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল পরিমাণ কাগজ উদ্বৃত্ত থাকছে। এ পরিস্থিতিতে শিল্পমালিকরা উৎপাদন কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে।

মাগুরা গ্রম্নপের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন জানান, ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক পেপার মিল বন্ধ হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংকটে আরও কিছু মিল বন্ধের উপক্রম। পণ্যের চাহিদায় ভাটা পড়ায় অনেক পেপার মিল ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে।

তার আশঙ্কা, এভাবে মিলগুলো বন্ধ হতে থাকলে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ যথাসময়ে সরবরাহ ব্যাহত হবে। কাগজ শিল্পখাতে ১ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই খাতের ওপর নির্ভরশীল ৩০০টির অধিক লিংকেজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রায় ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান ও জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। একইসঙ্গে, পুনরায় আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে কাগজ শিল্প এবং প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় হবে। কাগজ শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকার প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে