বাঘ ছানা ঘুমিয়ে আছে। ভীষণ রকম ঘুম। সেই যে রাতে ঘুমিয়ে পড়ল ছানাটি। এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল। কিন্তু নাক ডাকার শব্দ কানে আসছেই। বাঘ ছানার মা কাছে যায়, 'ওরে ও ছানা। এমনভাবে ঘুমাতে নেই। এত ঘুমালে তো শরীর খারাপ করবে। কম ঘুম যেমন খারাপ, তেমনি বেশি ঘুমও শরীর ও মনের জন্য খুবই খারাপ।' বাঘ ছানা ঘুম থেকে ওঠে তাকায় মায়ের দিকে। ভ্রম্নকুটি করে বলে, 'ধুর মা। কে বলেছে ঘুমালে শরীর খারাপ হবে। বরং ঘুমালেই শরীর আরও শক্ত সামর্থ্য হবে। তুমি যাও তো। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাব। দিনের আলো আমার কাছে বিশ্রি রকম খারাপ লাগে। রাত হলে তবুও একটু ভালো লাগে।' মা বাঘ ভীষণ অবাক হয়। বলে কি ছানাটি! সে নাকি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবে। চোখ দুটো বড় বড় করে মা বাঘ বলে, 'তোর কি ক্ষুধাও লাগে না রে ছানা?'
'ক্ষুধা তো লাগে। এই যেমন এখন প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। মনে হচ্ছে হাতের কাছে যা পাব সব খেয়ে ফেলব।'
'তাহলে চল আমরা শিকারে যাই। তোকে তো শিকার শিখতে হবে। শিকার না করলে তো খেতে পারবি না। ক্ষুধাও নিবারণ হবে না।'
'হবে মা, হবে। শিকার না করলেও ক্ষুধা নিবারণ হবে। তুমি তো এতদিন আমাকে খাইয়েছ। এখনো না হয় খাওয়াবে। আর জানো মা, শিকারে গেলে আমার ঘুমটা নষ্ট হবে। শিকার করা খুব কষ্টের। অনেক দৌড়াতে হয়। এত সুন্দর আমার চারটি পা। দৌড়াতে গেলে যদি পায়ে আঘাত পাই, তখন তুমিই কষ্ট পাবে। এই যে গায়ের সুন্দর হলুদ ডোরাকাটা রং; শিকার করতে গেলে গায়ে আঁচড় লাগতে পারে। তার চেয়ে ভালো হয়। তুমি আমাকে শিকার ধরে এনে খাইয়ে দাও। আমি আরও কিছুক্ষণ ঘুমাই।'
মা বাঘের ইচ্ছা করছে ছানাকে নিয়ে শিকারে যেতে। ওকে শিকার শেখানো উচিত। যাতে ভবিষ্যতে তার কোনো সমস্যা না হয়। ওরও তো একটা জীবন আছে। জীবন বাঁচিয়ে চলতে গেলে তো কষ্ট করতেই হবে। খাবার তো আর এমনি এমনি আসে না। মা চিন্তা করল, আজ আর না। কাল না হয় ছানাকে নিয়ে শিকারে যাওয়া যাবে। পরের দিন সকালবেলা মা যায় ছানার কাছে। ছানা ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে সুরুৎ, পুরুৎ, কুরুৎ। ফ-ও-ও-ও-অর, ফুস। আজও শিকারে যেতে চায় না বাঘ ছানা। বলে, 'দেখো না মা আমার এই সুন্দর দাঁতগুলো। যদি শিকারে যাই তাহলে দাঁতে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারি। তাহলে তো আমারই ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তো শিকার করতে পারব না। তখন কি হবে মা। তুমি তো আছই। তুমি থাকতে আমার কোনো চিন্তা নেই। আজও তুমি আমাকে শিকার করে নিয়ে এসে দেবে।' মা আজও চলে যায়। শিকার করে ছানাকে খাওয়ায়। পরের দিনও একই অবস্থা। আজকের অজুহাত পায়ের নখের। ছানা বলে, 'শিকার করলে পায়ের নখও তো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাহলে ভবিষ্যতে আর শিকার করতে পারব না। তুমি তো এখনো আছই।'
এভাবেই চলে গেল অনেক দিন। একদিন বুড়ো হয়ে গেল মা বাঘ। তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সে ছানাকে শিকার করা শেখাতে পারল না। মা আর ছানা বাঘ গুহাতেই বসে থাকত। একদিন, দুইদিন, তিনদিন। দুইজনেরই ক্ষুধায় মরি মরি অবস্থা। বয়সের ভারে মা বাঘের শিকারের ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। ক্ষুধা জ্বালা সইতে না পেরে ছানা বাঘ বের হয়ে আসে গুহা থেকে। আজ দেখিয়ে দিতেই হবে। যেভাবেই হোক, সে শিকার করে নিজেও খাবে, মাকেও খাওয়াবে।
জোরে একটা হালুম ডাক ছাড়ে। কিন্তু কি আশ্চর্য! হালুম ডাকে কোনো জোরই নেই! আরও একবার ডাকার চেষ্টা করে। এবার গলায় ব্যথা পায়। কোনো দিন তো এত জোরে ডাকেনি সে। শুধু ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। বুক ফুলিয়ে সামনে এগোয়। কি শিকার করবে সে? মা কী শিকার করত সেটা তো সে জানেই না! শুধু সে জানে মা তাকে মাংস দিত। সে খেতো আরাম করে। একটু এগিয়ে যাওয়ার পর সামনে একটা হরিণকে দেখে বাঘ ছানা। বনে নতুন বাঘ দেখে অবাক হয়ে যায় হরিণ। বাঘ হরিণকে ধরার জন্য দৌড় দেয়। কিন্তু সে তো ভালোভাবে দৌড়াতেও পারছে না। দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল কয়েকবার। হরিণের বিকট হাসি পায়। বাঘ দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে। দাঁত বের করে হাসে হরিণ।
হা হা হা। হু হু হু। হি হি হি।
হোঁচট খায় বাঘ মামা, ছি ছি ছি।
বেশ কয়েকবার পড়ে গিয়ে অবশেষে হরিণকে ধরতে পারে সে। কিন্তু এখানেও বাধে বিপত্তি। হরিণের কোথায় কামড়ে ধরতে হয় সেটাও তো সে জানে না। কোনোমতে হরিণের পায়ে কামড় দেয় বাঘ। হরিণ হাসতেই থাকে। পা দিয়ে ঝটকা মারে হরিণ। হরিণের পায়ের আঘাতে ছিটকে যায় বাঘ। বাঘের এমন করুণ অবস্থা দেখে বনের অন্যান্য পশু-পাখিরা অদ্ভুত হা করে তাকিয়ে থাকে। বাঘের তো এমন আচরণ হওয়ার কথা না। বাঘ হবে শক্তিশালী। কিন্তু তার শক্তি কোথায় গেল! বাঘ ছানা আবার উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু সে হরিণকে ভয় পেতে শুরু করে। ছোট থেকে এত বয়স হয়ে গেছে, সে তো শিকার করা শেখেনি। তাই দাঁতে ব্যথা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে, দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে তার। পায়ের নখে মরিচা ধরেছে। ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে শ্যাওলা জমেছে শরীরের প্রতিটি জায়গায়। সামনে তাকিয়ে দেখে অনেক হরিণ তাকিয়ে দেখছে তাকে। হাসছে, নাচছে, গাইছে তারা মনের আনন্দে। এত এত হরিণ দেখে বাঘের ভীষণ রকম ভয় হয়। যদি সব হরিণ একসঙ্গে তাকে লাথি মারে তাহলে জীবনটা শেষ। এবার উল্টো পথে দৌড় দেয় সে। গুহায় যেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলে, 'মা আমি ভুল করেছি। ছোটবেলায় অলসতা করে আমি শিকার করতে শিখিনি। ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি আমি দিনের বেশিরভাগ সময়। আমি তোমার ওপর নির্ভর করে থাকতাম। এই অলসতা, পরনির্ভরশীলতা আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এখন আর শিকার করতে পারছি না। হরিণের পায়ের আঘাতে চিটপটাং হয়ে যাচ্ছি। মা আমি শিকার শিখতে চাই। আমি ভালোভাবে বাঁচতে চাই।'
কিন্তু বৃদ্ধ মায়ের তখন আর কিছুই করার ছিল না। এভাবেই অলসতা আর পরনির্ভরশীলতা বাঘ ছানার জীবনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।