মেঠো পথ ধরে গ্রামে ঢুকতেই রাস্তার দু'ধারে চোখে পড়ে সারি সারি সুপারি গাছ। দেখতে যেন রূপকথার দেশ। যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। সবুজ-শ্যামল এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা নদী। যে নদীর বুকে শত শত মৎস্যজীবী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। নদীর বুকে বালুচর জেগে উঠলে ফসল ফলানোর জন্য কৃষক-কৃষানি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেখানে রাতের আকাশে মিটিমিটি তারা হাসে। রুপালি চাঁদ জোছনা ছড়িয়ে মেঘের ভেলায় ভাসে। জোনাকিরা মিট মিট আলো জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়ায় সন্ধ্যা হলে। গভীর রাতে গ্রামের তেপান্তরের মাঠ থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ওই হাঁক। আর এই গ্রামটির নাম হচ্ছে নীলগঞ্জ।
এক সময় এই গ্রামে নীলচাষ হতো। ১৮ শতকে শুরু হয় এর চাষ। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড প্রথম নীলচাষ শুরু করেন, তারা গড়ে তুলে নীলকুঠি। লাভজনক চাষ হওয়ার কারণে অন্যান্য পেশার লোকজন নীলচাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে আর ক্রমান্বয়ে নীলচাষের বিষাক্ত ছোবলে কৃষকরা নীল হয়ে ওঠে। ইংরেজরা কৌশলে পাতিদার-জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করে সাধারণ কৃষকদের অত্যাচার করে এ নীলচাষ করাতো। যারা নীলচাষে অনিচ্ছুক বা ঠিকমতো উৎপাদনে ব্যর্থ হতো ওই কৃষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো ইংরেজদের কুঠিরে; কৃষকদের মাথায় কাঁদা লেপ্টে নীলবীজ রোপণ করা হতো। যত দিন চারা না গজাতো তত দিন খাবার না দিয়ে বন্দি রাখা হতো। ইংরেজ বণিকদের এমন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষকরা নীলচাষ করতে অস্বীকার করে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে রুখে শুরু হয় নীল বিদ্রোহ। এ দেশের কৃষকদের আন্দোলনের মুখে দাঁড়াতে না পেয়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়। যা আজো গ্রামের মানুষের মুখে গল্প কথা হয়ে আছে। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম নীলগঞ্জ।
সেই অনেক দিন আগের কথা। দীর্ঘ দিন পর তাদের গ্রামে পুনরায় জনরব ভেসে ওঠে। নদীর কিনারায় বসাবাসের উপযুক্ত স্থানগুলোতে বিভিন্ন এলাকার কৃষিজীবীরা পর্যায়ক্রমে এসে চাষাবাদ শুরু করে। যার কারণে গ্রামটির বসাবসের অধিকাংশ স্থান কৃষিজীবীদের দখলে। আর অল্প কিছু স্থান বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের দখলে। গ্রামটিতে বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ থাকলেও সবাই বন্ধুর মতো মিলেমিশে বসবাস করে। কিন্তু ওই গ্রামে এখনো অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নীলকুঠিরের ধ্বংসাবশেষ।
বহু বছরের পুরোনো নীলকুঠির ধ্বংসস্তূপগুলোতে মিশে আছে রহস্যময় নানান ঘটনা আর অদ্ভুত সব গল্প।
আর সেই সবুজ-শ্যামল অপার মায়ায় ঘেরা এই গ্রামে বাস করে দীপা। সে নীলগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একবার সে তার দাদুর মুখে নীল কুঠির সম্পর্কে অদ্ভুত গল্প শুনেছিল। এই কুঠিরটি নাকি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক দীননাথ সিংহ। তিনি ছিলেন কুখ্যাত নীলকর উইলিয়াম রেনির অন্যতম সহযোগী। পাকিস্তান আমলে জনৈক মোক্তার এ বাড়িতে বসবাস করতে আসেন। তার এক ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়িতে মারা যান। এরপর গোলাম জব্বার নামে এক ডাক্তার এ বাড়িতে বাস করতে এলে শীলা নামে তার একমাত্র কন্যাও আত্মহত্যা করেন। এছাড়া রাতের বেলায় এ কুঠির থেকে নারীকণ্ঠে হাসির শব্দ, আবার কখনো ছায়ামূর্তি দেখা যেত। এলাকার পুরানো বাসিন্দা মোবারক সাহেব নাকি একদিন এমন একজনকে দেখেছেন যে কিনা মাথা কাটা অবস্থায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরছিলেন। এমন শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য অনেকেই দেখেছে। এমন গল্পের যেন কোনো শেষ নেই।
সাধারণ লোকজনের ধারণা, এগুলো সব নাকি ভূতের কাজ। এখানে এত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় নীলগঞ্জবাসীর কাছে কুঠিরটি ভীতিকর ও রহস্যময়।