সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজ কৃষকের জীবনমান বদলাচ্ছে

ফরিদপুর প্রতিনিধি
  ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজ কৃষকের জীবনমান বদলাচ্ছে
ফরিদপুরে কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজ চাষে ব্যস্ত কৃষক -যাযাদি

পেঁয়াজের সাদা কদম শুকিয়ে বের হয় কালো দানা বা বীজ, যার বাজার দর আকাশ ছোঁয়া। তাই একে বলা হয় কালো সোনা। এক সময় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর থাকলেও দিন দিন দেশে এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের আবাদ বাড়ছে। বর্তমানে সারা দেশে পেঁয়াজ বীজের যে চাহিদা তার ৫০ শতাংশ জোগান দেয় ফরিদপুরের চাষিরা।

চলতি মৌসুমে জেলার চাষিদের সব মিলিয়ে পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন প্রায় তিনশ' কোটি টাকার বাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও প্রাকৃতিক পরাগায়নের অভাবে এবার আবাদের তুলনায় পেঁয়াজ বীজের উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে ও কৃষি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে এ তথ্য।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলার ৯টি উপজেলায় পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে প্রায় সাড়ে ৭ মেট্রিক টনেরও বেশি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে জেলা সদরে প্রায় ২০৮ হেক্টর জমিতে।

গত বছর জেলায় ১ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করা হয়েছিল। গতবারের তুলনায় এবছর আবাদের পরিমাণ বেড়েছে। ভালো লাভ পাওয়ায় এই ফসলের দিকে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। এছাড়া সরকারের বিশেষ তদারকি থাকায় স্থানীয় কৃষি দপ্তরও এই পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছে।

ফরিদপুরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলাকার লাভলি আক্তার ও ইমতাজ মোলস্না দম্পত্তি গত এক যুগ ধরে পেঁয়াজ বীজ চাষ করছেন। দুই বিঘা দিয়ে শুরু করে এখন তারা জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ৪০ বিঘা জমিতে এবছর পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছেন। নুন আনতে পান্তা ফুরাত এক সময় তাদের। কিন্তু এখন এই পরিবার কোটিপতি। নিজস্ব জমিতে তাদের পাকা ইমারতে বহুতল ভবনে যেমন জৌলুস বেড়েছে, তেমনি জীবনযাপনে এসেছে ঊর্ধ্বমুখী পরিবর্তন। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি মেয়ে নিয়ে এখন তাদের ব্যয়বহুল সংসার। যা এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের বদৌলতে তাদের কাছে ধরা দিয়েছে। প্রতি বছর তারা উপার্জনের টাকায় নিজেদের স্থাবর সম্পত্তিও বাড়াতে পারছেন। নতুন করে কিনছেন জায়গা জমি।

জীবন বদলে যাওয়ার মতো এই অনুপ্রেরণার গল্প জানা যায় লাভলি আক্তারের মুখে। তিনি বলেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে দেখেন শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পেঁয়াজ বীজের চাষ করছেন। তিনিও স্বামীকে সহায়তায় নামেন। এতে প্রথম বছরেই ভালো আয় হয় তাদের। এরপর আর থেমে থাকেননি।

লাভলী আক্তার বলেন, 'আমি এই বীজের টাকা দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িতে বিল্ডিং দিয়েছি। প্রতি বছরই নতুন জমি কিনছি। এক সময় যা ছিল অকল্পনীয়, এখন তাই বাস্তব আমাদের কাছে।'

লাভলী জানান, আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার তারা বিঘাপ্রতি দুই থেকে আড়াই মণ পেঁয়াজ বীজ পাবেন। প্রতি বিঘা জমিতে এই বীজের আবাদ করতে এক লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। সেই হিসাবে সব মিলিয়ে তাদের এবার প্রায় কোটি টাকার মতো লাভ থাকবে। ফরিদপুর সদর কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, বরাবরই ফরিদপুরের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ বীজের আবাদের উপযোগী। তাই আগা গোরাই এখানে বীজের ব্যাপক আবাদ হয়। মূলত ফরিদপুরে তিন ধরনের পেঁয়াজ আবাদ হয়। সারা দেশের মধ্যে বীজের আবাদে ফরিদপুর সব সময় এগিয়ে। দেশের চাহিদার ৫০ শতাংশ বীজ যায় এই জেলা থেকেই।

বীজ চাষিরা জানালেন, এ বছর মৌমাছির অভাবে এই পেঁয়াজ বীজের গাছে পরাগায়নের মাত্রা কমে এসেছে। নিরুপায় কৃষক হাতের তালু বুলিয়ে এক ফুলের রেণুর সঙ্গে আরেক ফুলের রেণুর পরাগায়নের পন্থাও বেছে নেন। কিন্তু এতে প্রাকৃতিক পরাগায়নের মতো ভালো ফলন হয়নি। আর তাই গত বছরের চেয়ে কিছু বেশি জমিতে চাষ হলেও এবার গতবারের চেয়ে উৎপাদন কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পেঁয়াজ বীজ আবাদে ছোট্ট শিশু প্রতিপালনের মতোই যত্নশীল থাকতে হয়। কোন রকম অযত্ন হলে ফলন নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষেতে বীজের আবাদ শুরু হয় নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরে। আর ফলন পাওয়া যায় এপ্রিল থেকে মে মাসের দিকে। ক্ষেত থেকে তোলার পর একবছর এই বীজ সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ পরবর্তী বছরে গিয়ে কৃষকরা এই বীজটি সংগ্রহ করে ক্ষেতে বপন করেন। কালো সোনা খ্যাত এই পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ করে জীবনের গল্প বদলে নিয়েছেন ফরিদপুরের দরিদ্র কৃষকরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কৃষকদের স্বার্থে তাদের সুযোগ-সুবিধার দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এমনটিই প্রত্যাশা পেঁয়াজ বীজ চাষিদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে জেলার কৃষকরা এবার সাড়ে ৭ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন করবে। যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। জেলার চাষিদের সমস্যা নিরসনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সব ধরনের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা করে আসছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে