সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মধু সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছে মৌ-চাষি

সিরাজগঞ্জে দিগন্ত জুড়ে সরিষা ফুলে স্বপ্ন দেখছে কৃষক

স্বদেশ ডেস্ক
  ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সিরাজগঞ্জে দিগন্ত জুড়ে সরিষা ফুলে স্বপ্ন দেখছে কৃষক
সিরাজগঞ্জে দিগন্ত জুড়ে সরিষা ফুলে স্বপ্ন দেখছে কৃষক

মাঠে মাঠে হলুদ রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে। দু'চোখ যে দিকে যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। এমন নয়নাভিরাম সরিষা ফুলের দৃশ্য আর মৌমাছির গুঞ্জন মনকে বিমোহিত করে। এখন সরিষা গাছে ফুল ধরেছে, আর কিছুদিন পরেই আসবে ফল। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলে কৃষক সরিষায় ভালো ফলনের আশা করছেন। অন্যদিকে, মৌ-চাষিরা মৌমাছির বাক্স নিয়ে সরিষা ক্ষেতে মধু সংগ্রহ করছেন। প্রতিনিধিদেও পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে দিগন্ত জুড়ে সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহে বিস্তীর্ণ এলাকা। পৌষের সকালের শিশিরে ভেজা ফসলের মাঠ হলুদ সরিষার ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। সরিষার হলুদ ফুল যেন চাদরে মোড়ানো অপরুপ সৌন্দর্যের শোভা ছড়াচ্ছে। সরিষা ফুলের চারিপাশে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হচ্ছে যেমন মাঠ, তেমনি বাম্পার ফলনের আশায় বুক বেঁধেছেন কৃষকরা। প্রকৃতির রঙ বদলানো সোনালীর রূপে মাঠ জুড়ে সরিষার ফুলের মধ্যে বিভিন্ন বয়সী নারী, পুরুষসহ শিশুরা সেলফি তুলতে ছুটে আসছে।

1

সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর, রায়গঞ্জ, উলস্নাপাড়া, তাড়াশ, শাহজাদপুর, কামারখন্দ, বেলকুচিসহ সদরের বিভিন্ন কৃষি ক্ষেতে সরিষার চাষ করা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের মাঠ সরিষা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বর্ষার পানি নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সরিষার আবাদ করা হয় এতে ফলনও ভালো হয়।

সদরের রতনকান্দি, বাগবাটী, ছোনগাছা, বহুলী, শিয়ালকোল, সয়দাবাদ, কালিয়াহরিপুর, কাওয়াকোলা ও মেছড়াসহ জেলার ৯ উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকার বলেন, এ বছর ৮৬ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করা হয়েছে। যদিও চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার হেক্টর।তবে বিগত বছরের তুলনায় এবার ১ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ বেড়েছে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরিষার বাজার মুল্য প্রতি মণ ৩ হাজার টাকা। সরিষার বাজার বেশি হওয়া ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকরা সরিষা চাষাবাদ বেশি করছেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি বিভাগ থেকে সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এবারে সরিষার মধ্যে টরি-৭, বারি-১৪, বীনা-৯, বীনা-১৪ চাষাবাদ করা হয়েছে বেশি।

এদিকে সরিষার ফুলের মধু সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছে মৌচাষিরা। জমিতে বসানো হয়েছে মৌ-বাক্স। সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মৌ চাষিরা এ মৌ বাক্স বসিয়েছে। এবার মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪শ' মেট্রিক টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফলন ও মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ধান বা অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা দিন দিন সরিষা চাষে ঝুঁকে পড়ছে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভবনা রয়েছে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় বারি-১৮ জাতসহ বারি-১৪,১৫,৯,১১,১৭ জাতের সরিষার আবাদ হয়েছে ২২৮৪ হেক্টর জমিতে। এটি গত বছরের তুলনায় কম। গত মৌসুমে সরিষার আবাদ হয়েছিল ২৬৬৫ জেক্টর জমিতে। তবে এ বছর সরিষার আবাদ কমলেও বেড়েছে আলুর আবাদ।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- ফসলের মাঠ সরিষা ফুলের হলুদ রঙে অপরুপ শোভা ধারণ করেছে। পৌরসভার শ্যামপুর এলাকার সরিষা চাষি কাদের আলী বলেন, কয়েক বছর আগেও তাদের জমি পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকত। বর্তমান সে জমিতে সরিষা আবাদ করা হচ্ছে। সরিষা ঘরে ওঠানোর পর আবার সেই জমিতে ধান লাগানো হবে।

উপজেলার বুলাকীপুর ইউনিয়নের কুলান্দপুর গ্রামের আইনুল হক ও শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামের সাফিকুল ইসলাম বলেন, সরিষা চাষ করতে প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। এ পরিমাণ জমিতে খরচ বাদে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাভ হবে আশা করছেন। সরিষা চাষের জন্য জমিতে যে সার ব্যবহার করেন পরবর্তীতে বোরো ধান আবাদের সময় সার বেশি দিতে হয় না। এতে তাদের খরচ কিছুটা কমে।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফারুক হোসেন জানান, বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে উপজেলার কৃষকরা সাধারণত সরিষা চাষ করে থাকেন। এ ফসল বিক্রি করে যে টাকা পান তা দিয়ে ধান রোপণ কাজে ব্যয় করেন।

উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. রফিকুজ্জামান জানান, 'প্রণোদনার আওতায় আমরা চলতি মৌসুমে দেড়শ' কৃষককে বীজ ও সার সরবরাহ করেছি। পাশাপাশি উপসহকরী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে তাদের নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন।'

ফকিরহাট (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটের ফকিরহাটে তেল জাতীয় ফসল সরিষার চাষ করায় এবার বাম্পার ফলনের সম্ভবনা রয়েছে। কৃষি বিভাগের নানাবিধ পরামর্শ সার বীজ প্রদান এবং চলতি মৌসুমে আবাহওয়া অনুকূলে থাকায় বিলগুলোতে সরিষার বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি বিভাগ জানান, এবছর উপজেলায় ২০২৩-২৪ এ সরিষা আবাদ হয়েছিল ১৬০ হেক্টর জমিতে। ২০২৪-২৫ এ লক্ষ্যমাত্রা ১৬৪ হেক্টর। সে তুলনায় এবার ২০২৪-২৫ এ অর্জন হয়েছে ১৬৫.৫ হেক্টর জমিতে। উপজেলার ৮ ইউনিয়নের ১৬৫০জন কৃষক সরিষার চাষ করছেন। এরমধ্যে ৬৫০জন কৃষককে বীজ ও সার বিতরণ করেছে কৃষি বিভাগ। তারমধ্যে ২০০জনকে প্রণোদনার বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি উৎপাদন হবে এমনটাই আশা করছেন কর্মকর্তারা।

বিভিন্ন বস্নকের আজহার আলী শেখ, বাবলু শেখ, নিজাম মোড়ল, রকমান মোড়ল, রফি শেখ, সাধন বিশ্বাসসহ অনেক কৃষক জানান, একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ করলে জমির উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাই কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে সরিষার চাষ শুরু করেন তারা।

কৃষক আজহার আলী শেখ জানান, তিনি এবার বারি-১৪/৯ ও রিনা-৯ জাতের বীজ চাষ করেছেন। আমন ধান থাকা অবস্থায় সরিষা ছড়িয়ে দেন জমিতে। এ জমিতে বোরো ধানও লাগাবেন তিনি। এভাবে তিনি এক বছরে একই জমি থেকে একটি বাড়তি ফসল ঘরে তুলবেন।

ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখনো আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চাষিরা ভালো ফলনের আশা করছেন। ভালো ফলন ও ন্যায্য দাম পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে সরিষা চাষে চাষিদের উৎসাহিত করছে ফকিরহাট কৃষি বিভাগ। সহজ চাষ পদ্ধতির কারণে চাষিরা তাদের জমিতে সরিষা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আমন ধান কাটার পর তারা জমিতে সরিষা চাষ করেন। সরিষা কাটার পর একই জমিতে তাদের প্রধান ফসল বোরো ধান চাষ করবেন। যাদের জমিতে শুধু আমন আর বোরো দুইটি ফসল হয় তারা সহজেই এই পদ্ধততি গ্রহণ করতে পারবেন। নভেম্বর মাসে সরিষার চাষ করলে জানুয়ারী মাস অর্থাৎ বপনের আড়াই মাস থেকে তিন মাসের মধ্যে এই ফসল ঘরে তোলা যায়। তাই সবাইকে ধানের পাশাপাশি সরিষা চাষে পরামর্শ দিয়েছেন।

দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, শীতের শিশির ভেজা সকালে ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সরিষার হলুদ ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার দিগন্ত জোড়া মাঠ। তবে এবার দুপচাঁচিয়ায় জমির মাটিতে আদ্রতা বেশি থাকায় সরিষা দেরিতে বপন করা হয়। তাই করায় এখনও কিছু ক্ষেতে পুরোদমে ফুল আসেনি।

উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। গত বছর ৪ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল। এবার আমন ধান ঘরে ওঠার আগে বৃষ্টিপাত হওয়ার জমির মাটিতে আদ্রতা বেশি থাকায় ইচ্ছা থাকলেও অনেক চাষি কাঙ্ক্ষিত জমিতে সরিষা চাষ করতে পারেননি। তবে বেশির ভাগ জমিতে বারি-১৪, বারি-১৫, বারি-১৭, বারি-১৮ জাতের সরিষা চাষ হয়েছে।

উপজেলার সোনার পাড়া গ্রামের চাষি কফিন উদ্দিন ও দীঘির পাড়া গ্রামের চাষি নাসির উদ্দীন জানান, সরিষা একটি লাভজনক ফসল। অন্য ফসলের মতো এর আবাদে পরিশ্রম কম। গত বছর সরিষা চাষ করে ভালো ফলন হয়েছিল। দামও ভালো পান। এবার প্রায় তিন বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। বর্তমানে ক্ষেতের যে অবস্থা তাতে এবারও সরিষার ভালো ফলন হবে বলে আশা তাদের।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাজেদুল আলম বলেন, এবার মাটির আদ্রতা বেশি থাকায় গত বছরের চেয়ে ৯১০ হেক্টর কম পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। সরিষা ঘরে ওঠার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যদি আবহাওয়া উপযোগী থাকে তাহলে উৎপাদন ভালো হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে