লবণ পানি-অধু্যষিত উপকূলবর্তী খুলনার দক্ষিণ জনপদ পাইকগাছা। এ অঞ্চলে সুপেয় পানির বড়ই অভাব। এলাকার মানুষ ছোটবড় পুকুর, দীঘি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি শোধন ও সরবরাহ করে থাকে। পাইকগাছা পৌরসভাও এর ব্যতিক্রম নয়।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পৌরসভায় গভীর নলকূপ বসানোর উপযুক্ত নয়। আবার পানি সংরক্ষণের মত বড় পুকুরেরও অভাব। দীর্ঘদিন ধরে সুপেয় পানির চরম সংকট হওয়ায় পানির অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছে এলাকাবাসী। পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারায় অনেকেই পুকুরের শ্যাওলাভর্তি, দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন পৌরবাসী।
সরজমিনে দেখা যায়- পৌর সদরস্থ মধুমতি পার্কে পানি প্রকল্পের আওতায় বি বস্নকে পানি নিতে আসা শুধু পৌরবাসী নয় পার্শ্ববর্তী লস্কর ইউনিয়নের কড়ুলিয়া গ্রাম, স্মরণখালী, মাঠাম, আলমতলা নারী-পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কেউ কলসে, কেউ পটে করে পানি সংগ্রহ করেন। সেখানে এখন ধূ ধূ করছে। জনশূন্য। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ৯নং ওয়ার্ড থেকে আসা চঞ্চলা রাণী, আরতী ও নাজমা আক্তারদের সঙ্গে কথা হলে বলেন, 'এখান থেকে আমরা নিয়মিত পানি সংগ্রহ করি। কয়েক দিন ধরে পানি নেই। বাধ্য হয়ে পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করছি।' উপজেলার লোনা পানি কেন্দ্রের পুকুর থেকে ড্রামে পানি তোলার সময় ভ্যানচালক সুশান্ত মন্ডল বলেন, 'পৌরসভা যে পানি দেয় খাওয়া যায় না। আমি প্রায় ৩-৪ কিলোমটার দূরে শিববাটি, পাশে সরল ও বাতিখালী গ্রামের অনেক মানুষদের খাওয়ার জন্য এখান থেকে পানি সরবরাহ করি। আর পৌরসভা আজকে পানি দেয় তো কালকে দেয় না।' উপজেলা মডেল মসজিদের ইমাম আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'সম্প্রতি পানি সাপস্নাই অনিয়মিত। শুনেছি পানি সংকটের কারণে পৌরসভা পানি দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু পানি ছাড়া তো এক দিনও চলা যায় না।'
এরকম নানাবিধ অভিযোগের কথা শোনা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পুকুর থেকে পানি নিতে আসা রুপালী, আক্তারের মা, বাসন্তী রাণী, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ছ্যালোযুক্ত পুকুর থেকে পানি আনা শেফালী, অর্চনা রাণী, উপজেলা পরিষদের পুকুর থেকে পানি আনা নজর আলী, রোজিনা, আমেনাদের। প্রত্যেকেই অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে শ্যাওলাভর্তি, দুর্গন্ধযুক্ত পুকুরের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
এদিকে জানা যায়, পানির সংকট নিরসনে প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯১৪ সাল থেকে পৌর পানি শাখার মাধ্যমে ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে পানি সরবরাহ শুরু করে পৌর কর্তৃপক্ষ। ওই বছরই সরল পুকুর পাড়ে তিনটি পাম্প হাউজের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে ট্রিটমেন্ট করে সরবরাহ করেন। তখন গ্রাহক সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০টি। বর্তমানে হাউজের সংখ্যা ৫ হাজারের উর্ধ্বে। এত বিপুল চাহিদার মধ্যে পৌর কর্তৃপক্ষ মাত্র ১২শ' গ্রাহকদের পাইপ লাইনের মাধ্যমে সকালে ও বিকেলে সুপেয় পানি সরবরাহ করে আসছিল। আর পানি সংকটে বান্দিকাটি, গোপালপুরের ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডে বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। পানি সংকটে ওই তিন ওয়ার্ড পানি দিতে না পারার দায়ভার স্বীকার করেছেন কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি মানুষের চাহিদার তুলনায় পৌরসভায় পানি অনেক কম দিতে বাধ্য হচ্ছে। সকাল বিকাল দুইবারের পরিবর্তে একবার পানি সরবরাহ করছে। অনেক সময় একদিন পর পর পানি সরবরাহ করে। পানি মানসহ বিবিধ প্রশ্ন উঠলে পৌর পানি সরবরাহ শাখা বিলক্লার্ক শাহিনুর হোসেন জানান, পানির গুণাগুণ ভালো আছে কিনা তার জন্য প্রতি ৬ মাস পর পর কুয়েট খুলনা হতে পানি টেস্ট করা হয়। গ্রাহককে ভালো পানি দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে পৌরসভার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন গদাইপুরের মানিকতলা নামক স্থানে একটা বোরিং করে সেখান থেকে পানি সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু দিন দিন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ায় একটা পাম্প হাউজ দিয়ে পানি সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একটি পাম্প যদি নষ্ট হয় তখন সেটি মেরামত করতে সময় লাগে মিনিমাম ৭ দিন। যার কারণে পৌরসভা গদাইপুর মোড়ে একটি জমি ক্রয় করে। পুকুর থাকায় সেটা ভরাট করে সেখানে একটি পাকা পাম্প হাউজের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে পৌরসভার অর্থায়নে। বিদু্যৎ এর ফোর ফোরটি লাইন না থাকায় বিদু্যৎ অফিস প্রায় লক্ষাধিক টাকা জমা দিয়ে দুইটি কারেন্টের পোল ক্রয় করে নির্মাণ করা হয়। সেখানে নিজস্ব তিনটি ট্রান্সমিটার ক্রয় করে বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। কারেন্টের সংযোগও নেওয়া শেষ। মানিকতলা হতে গদাইপুর জমি পযর্ন্ত ৪'' ক্লাস পাইপ বসানোর কাজও শেষ হয়েছে। জনগনের নিকট ভালো পানি দেওয়ার জন্য এখন বোরিং কাজ শেষ হওযা জরুরি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মাহবুবর রহমান বলেন, এভাবে চলতে থাকলে হেপাটাইটিস এ, কলেরা, টাইফয়েড, আমাশা, ডায়রিয়া, এলার্জিসহ পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এরফলে এলাকাবাসী স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়বে।
পৌর প্রশাসক ও ইউএনও মাহেরা নাজনীন বলেন, আপনারা জানেন এ অঞ্চলটি লবণ পানি-অধু্যষিত। চারিদিকে পানি। তবে বিশুদ্ধ খাবার উপযোগী পানি নাই। পৌরসভার বর্তমান পানির গ্রাহকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় পানি সরবরাহ অনেক কম থাকায় এ সংকট উত্তরণে গদাইপুরে পাম্প হাউজের কাজ চলমান। সবার সহযোগিতায় খুব দ্রম্নত বাস্তবায়ন হলে পৌরসভা সহ আশেপাশের এলাকার মানুষের সুপেয় পানি আর সংকট থাকবে না।