সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
আমনের অধিক ফলনে খুশি পাহাড়ি কৃষক

অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা পাহাড়ের জলপাই

সাকিব এ মামুন, লংগদু (রাঙামাটি)
  ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা পাহাড়ের জলপাই
অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা পাহাড়ের জলপাই

উপকারী ফল জলপাইয়ের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে। এতে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদুর অনেক কৃষক লাভবান হয়েছেন। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে পাহাড়ের পাদদেশে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। পাহাড়ি উপজেলা লংগদুর বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে যতদূর চোখ যায় শুধু আমনের সোনালী পাকা ধান। শীতের হালকা কুয়াশায় মাখা ভোরের আকাশের সূর্য রশ্মি পড়ছে শিশির বিন্দুতে। জ্বলছে যেন মুক্ত দানার মত। প্রকৃতিতে হিমেল বাতাস তাতে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ, সঙ্গে শিশির ঝড়ে পড়ার টুপটাপ শব্দ আর সবুজ ধান গাছের সোনালি শীষে সোনা মাখা রোদ যেন ঝিলমিলিয়ে হাঁসছে। সব মিলিয়ে খুশি পাহাড়ি কৃষক।

জানা যায়, আগে রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন বাড়িতে শখের বসে অনেকে জলপাই গাছের চারা রোপণ করেছেন। উৎপাদিত ফল নিজেরা খেতেন। পরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ও বিপণন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় এখন এখানকার কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে বাগান আকারে জলপাই চাষ শুরু করেছেন। এর মধ্যে লংগদু উপজেলা অন্যতম। ফলে জলপাই চাষ পাহাড়ের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হওয়ার এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

1

চলতি মৌসুমে পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে জলপাইয়ের ভালো ফলনে রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। দাম ভালো পাওয়ায় জলপাই চাষিদের মুখে হাসি ফুটেছে।

কৃষকরা জানিয়েছেন, জলপাই চাষ লাভজনক। এতে খরচ তুলনামূলক কম। পরিচর্যার তেমন দরকার হয় না। সার ও ওষুধ লাগে না। বাড়ির আশেপাশে ও পতিত জমিতে গাছ লাগালেই হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ জেলার জমি ও আবহাওয়া বেশ ভালো জলপাই চাষের জন্য। রাঙামাটির প্রত্যেকটি উপজেলায় বাড়িতে বাড়িতে দু-একটি করে জলপাই গাছ দেখা যায়। এর বিস্তার ঘটানো গেলে বাণিজ্য প্রসার করা সম্ভব হবে।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গাছ থেকে জলপাই সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাইকাররা বাড়ি বাড়ি ঘুরে জলপাই সংগ্রহ করে এক জায়গায় একত্রিত করে বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করছেন। রাঙামাটির লংগদু উপজেলাতে মৌসুমি ফল জলপাইয়ের ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় চাষিরা আনন্দিত।

পাহাড়ি জনপদ লংগদুর গুলশাখালী ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম বলেন, 'আমি শখ করে বাড়ির পাশের জমির পাহাড়ি ঢালুতে ২০টি জলপাই গাছ লাগিয়েছি। এই গাছ দুই-তিন বছরের মধ্যে ফল দেয়। জলপাই গাছে এতো ফল আসে, যা পাতা থেকে ফল বেশি। ফলের অনেক চাহিদা। বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে হয় না। বাড়িতে পাইকার এসে নিয়ে যান। এ বছর প্রায় দুই লাখ টাকার জলপাই বিক্রি হয়েছে।'

একই এলাকার কৃষক রুবেল বলেন, 'আমি পাহাড়ের ২ একর ঢালু জমিতে ৫০টির মত জলপাই গাছের বাগান করেছি। শীতের শুরুতে ফল দেওয়া আরম্ভ হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে দাম ৫০-৬০ টাকা কেজি। উৎপাদনে খরচ কম, লাভ বেশি। ফলে বাণিজ্যিক চাষাবাদ মন্দ নয়।'

চট্টগ্রাম থেকে জলপাই কিনতে আসা ব্যবসায়ী কবির হোসেন জানান, 'পাহাড়ি এ এলাকার জলপাইয়ের আকার বড়। স্বাদে ভালো হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা রয়েছে। এখান থেকে জলপাই কিনে বিভিন্ন জেলায় পাঠাই।'

লংগদু কৃষি অফিসের উপ সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা রতন চৌধুরী জানান, এখানকার মাটি মাল্টা, কমলালেবু, পেয়ারা, বাতাবি লেবু ও জলপাই চাষের উপযোগী। এ কারণে অনেক কৃষক অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে এসব ফল চাষ করছেন। আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় কৃষি বিভাগের তদারকি বাড়ানো হয়েছে।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, লংগদুতে ১৫ হেক্টর জমিতে জলপাই চাষ হয়েছে। এবার ৩শ' মেট্রিক টন জলপাই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদ করা বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ জুড়ে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সোনালি ধান। তবে চলতি মৌসুমে সার ও কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধিতে আমন চাষে তুলনামূলক উৎপাদন খরচ বেড়েছে কৃষকের। এরপরও ভালো ফলনে খুশি পার্বত্যাঞ্চলের কৃষকরা। আর গত বছরের চেয়ে এবার ধানের দাম এক হাজার থেকে ১২শ' টাকা হওয়ায় লাভবান হওয়ার আশা তাদের।

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদুতে সরজমিনে দেখা যায়, একদিকে কেউ ধান কাটছেন কেউবা বাড়িতে তুলছেন পাকা ধানের আঁটি, আবার আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাড়াইয়ে ব্যস্ত কোনো চাষি। সবমিলিয়ে খুব আনন্দে হাসিমুখে আমন মৌসুমের পাকা ধান ঘরে তুলছেন স্থানীয় চাষিরা।

এদিকে দিন মজুররা দিনে ৭শ' থেকে ৮শ' টাকায় মজুরি পেয়ে খুশি। তবে বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে পারিশ্রমিক কিছুটা বেশিই আশা করেন তারা।

কৃষকরা বলছেন, পাহাড়ে পানি সংকট দূর হলে সারাবছর আবাদ করা সম্ভব। এখানকার আবহাওয়া অনুকূলে ও মাঠি যেকোনো চাষাবাদের জন্য উর্বর। সরকারের পানি প্রকল্প বা সেচ পাম্পের উদ্যোগ নিলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সুবিধা দিতে সক্ষম হবে পাহাড়ের চাষিরা।

লংগদু কৃষি অফিসের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা রতন চৌধুরী আমন চাষের বিষয়ে বলেন, প্রায় ৮০ শতাংশ ধান কেটে কৃষকরা ঘরে তুলেছেন। এবার ধানের উৎপাদন হয়েছে তুলনামূলক বেশি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এ আবাদ হতো আরও বহুগুণ। উপজেলায় ১ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭৪৯ মেট্রিক টন। এবার এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া কৃষকদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য কৃষি অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে