বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাঁশ শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবন

লংগদু (রাঙামাটি) প্রতিনিধি
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বাঁশ শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবন
রাঙামাটির লংগদুতে বিক্রির জন্য নদীপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাঁশ -যাযাদি

দেশের কাগজ কলগুলোর প্রধান কাঁচামাল বাঁশ। বিশেষ করে পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত কর্ণফুলী পেপার মিলের। যার প্রায় পুরোটার জোগানই দেশ থেকে হয়ে থাকে। বাঁশের বৃহৎ উৎস দেশের পার্বত্যাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকাগুলো। পার্বত্য অঞ্চলের গহিন থেকে এই বাঁশ সংগ্রহ প্রক্রিয়া মূলত এক কঠিন জীবন সংগ্রামেরই প্রতীক্ষিত ছবি।

যার প্রকৃত চিত্রের দেখা মেলে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ির দীঘিনালায়, রাঙামাটির লংগদু-বাঘাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত থানচি উপজেলায়।

1

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের সুবিশাল এলাকায় জুড়ে দেখা যায় একই চিত্র। দূরদূরান্ত থেকে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদী হয়ে বাঘাইছড়ির মারিশ্যা, মাইনীমুখ হয়ে ভাসিয়ে আনা হয় শত শত ভেলা।

কিন্তু মজুরি তাদের ক্ষেত্রে একেবারেই কম। অথচ বাস্তবতা হলো শ্রমিকের কষ্টসাধ্য শ্রমেই ঘুরছে বাঁশ শিল্প কাগজ কলের তথা দেশের অর্থনীতির চাকা।

তিন পার্বত্য জেলায় বাঁশ জন্মালেও দেশের চাহিদার সিংহভাগের জোগান আসে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে। বাঘাইছড়িতে অর্থনীতির মূল ভিত্তিই গড়ে উঠেছে বাঁশকে কেন্দ্র করে। উপজেলার পূর্ব লক্ষ্ণীছড়ি, পশ্চিম লক্ষ্ণীছড়ি, বাঘাইহাট, পাবলাখালী, মাচালং ও শিজক এলাকায় দুই লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ একর সংরক্ষিত বন রয়েছে। এছাড়া সাধারণ বনভূমি রয়েছে ৯৬ হাজার ৯৫৭ একর। বাঘাইছড়ির এই বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর বাঁশ জন্মায়। কাগজ কল কেপিএম এই বনভূমি থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে।

পার্বত্য এসব অঞ্চলের বাঁশশ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তিন-চার মাসের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পেছনে তাদের যে পরিমাণ শ্রম ও সময় ব্যয় হয়, মজুরি মেলে সে তুলনায় খুবই নগণ্য। একজন শ্রমিকের পক্ষে বছরে দু-তিনবারের অধিক চালান দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ একটানা লম্বা খাটুনির পর প্রয়োজন পড়ে বিশ্রামের।

শ্রমিকরা জানান, পাহাড় থেকে বিভিন্ন ছড়া দিয়ে মাইনী নদীতে আনা হয় এসব বাঁশের আঁটি। নদীতে বাঁশ আনার পর ভেলা তৈরির শ্রমিকেরা ৫০টি বাঁশ সংযুক্ত করে একটি ভেলা তৈরি করেন।

দুটি ভেলা পাশাপাশি করে সারিবদ্ধভাবে একটির সঙ্গে আরেকটি বেঁধে লম্বা ভেলা তৈরি করা হয়। ভেলা তৈরি শেষে নাড়াইছড়ি থেকে কয়েকজন শ্রমিক ভেলাটি ভাসিয়ে ৩০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে মাইনী নদী দিয়ে ধনপাতা এলাকায় অন্য শ্রমিকদের কাছে হস্তান্তর করেন। ধনপাতা থেকে কয়েকজন শ্রমিক ১৫ কিলোমিটার মাইনী নদীপথে ভেলা ভাসিয়ে মাইনী বেইলি সেতু এলাকায় অন্য শ্রমিকদের কাছে হস্তান্তর করেন। এভাবেই শ্রমিকদের হাতের পর হাত বদলে সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় কর্ণফুলী পেপার মিলস বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

ভেলাশ্রমিক মোজাফফর বললেন, 'এ কাজে আমরা তিন শতাধিক শ্রমিক কাজ করি। কিন্তু কাগজকলের দুরবস্থার কারণে এখন আর তেমন একটা বাঁশ নদীপথে যায় না। আমরা শ্রমিকেরা অনেকটা বেকার ও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি।'

তিনি আরও জানালেন, নদীতে পানি থাকলে প্রতি হাজার বাঁশ মাইনীমুখ পৌঁছে দিলে মজুরি পান ৪-৫ হাজার টাকা। সময় লাগে ৬-৮ দিন। পানি কম থাকলে মজুরি পান ৬-৭ হাজার টাকা। তখন সময় লাগে ১০-১২ দিন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে- মুলি, মিতিঙ্গা ওড়া, ডলু ও লতা প্রজাতির বাঁশ জন্মায় এখানকার পাহাড়ে। তবে বাঁশের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য জুন, জুলাই, আগস্ট এই তিন মাস বাঁশ কাটা সরকারিভাবে বন্ধ রাখা হয়। প্রতিবছর বাঁশ ও গাছ থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকে সরকারের। তবে এ বছর পাহাড়ের বাঁশ থেকে আশানুরূপ রাজস্ব আয় করতে সক্ষম নাও হতে পারে সরকার। কারণ আগের তুলনায় পাহাড়ে কমে গেছে বাঁশ ও এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে