মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) প্রশাসনের জারি করা একটি ছুটির নোটিশে পঞ্চাশের (৫০) অধিক ভুল হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বানান, বাক্য গঠন ও ভাষাগত ত্রুটিতে ভরা এই নোটিশটি নিয়ে শিক্ষার্থী ও সচেতন মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা।
নোটিশটি প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সরব হন। কেউ কেউ নোটিশটির ছবি তুলে ভুলগুলো চিহ্নিত করে পোস্ট করেন।
অনেকে মন্তব্য করেছেন, ‘একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দপ্তরের এমন অব্যবস্থাপনাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার প্রতিফলন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘নোটিশে বিপুলসংখ্যক ভুল থাকা একদিকে যেমন প্রশাসনের অযোগ্যতা প্রকাশ করে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কাছেও এটি লজ্জাজনক বার্তা দেয়।’
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী তরফদার রোহান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ।
এ বিদ্যাপীঠ থেকে যখন কোনো বিজ্ঞপ্তি বা প্রজ্ঞাপন জারি হয়, সেটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না—সারা দেশের মানুষ তা দেখে। অথচ দেখা যায়, অনেক সময় এসব নোটিশে মারাত্মক বানান ভুল থাকে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক।’
তিনি আরো বলেন, বিজ্ঞপ্তি প্রস্তুতকারীদের মধ্যে যারা এ ভুলের জন্য দায়ী হতে পারে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব। অনেক সময় দেখা যায়, তাদের কাজের যোগ্যতা যাচাই না করেই নিয়োগ দেওয়া হয়।
ফলে তারা সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এ সমস্যাগুলো যদি দ্রুত সংশোধন না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এসব ভুল নিয়ে ট্রল, সমালোচনা এমনকি বিদ্রূপও হতে পারে—যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তরফদার রোহান নামের এই শিক্ষার্থী মনে করেন, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
প্রশাসনের উচিত সংশ্লিষ্ট অফিসে কর্মরতদের বানানরীতি ও প্রজ্ঞাপন লেখার বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
প্রয়োজনে বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধান সরবরাহ করা। পাশাপাশি, অফিসপ্রধানদেরও দায়িত্ব নিতে হবে—তারা যেন প্রতিটি নোটিশ যথাযথভাবে যাচাই করে এবং বানানরীতি ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত করে।
শ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এত বানান ভুল মানা যায় না। প্রশাসনিক কাজে আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।’
গত ২৮ মে প্রকাশিত এ নোটিশে যে বানান ভুল ও অসংগতি রয়েছে তা বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী কিছু চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভুল: রেজিস্ট্রার → শুদ্ধ: রেজিস্ট্রার [এই বানানে এ-কারে মাত্রা যুক্ত করা হয়েছে। এ-কার চিহ্নে মাত্রা হয় না।]
ভুল: ফোনঃ → শুদ্ধ: ফোন: [ফোনের পর বিসর্গ ব্যবহার করা হয়েছে। বিসর্গ (ঃ) বর্ণ এবং কোলন (:) চিহ্ন বা সংকেত। বিসর্গ কোনো যতিচিহ্ন নয়, কোলনের পরিবর্তে বিসর্গের প্রয়োগ পরিহার্য।]
ভুল: টেলি-ফ্যাক্সঃ → শুদ্ধ: টেলিফ্যাক্স: [এখানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে হাইফেন (–) ও ‘ঃ’ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।] ভুল: সূত্রঃ → শুদ্ধ: সূত্র: [প্রাগুক্ত]
ভুল: রেজি → শুদ্ধ: রেজি. [সংক্ষিপ্ত শব্দের পরে ডট বসে: যেমন - ডা. (ডাক্তার), মো. (মোহাম্মদ) ইত্যাদি।] ভুল: একা → শুদ্ধ: অ্যাকা. [প্রাগুক্ত] ভুল: বি.ছু → শুদ্ধ: বি.ছু. [প্রাগুক্ত] ভুল: তারিখঃ → শুদ্ধ: তারিখ: [প্রাগুক্ত]
ভুল: ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ → শুদ্ধ: ১৩ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ [বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্ট ‘গ’-এ বাংলা তারিখ ও সময় লেখার নিয়ম বিধৃত।
এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্যে বলা হয়েছে: “অ্যাক বৈশাখ, অ্যাগারো জ্যৈষ্ঠ, শোলো ডিসেম্বর, পোঁচিশ বৈশাখ প্রভৃতি উচ্চারণ অশুদ্ধ। শুদ্ধ ও মান্য রীতি: পয়লা বৈশাখ, অ্যাগারোই জ্যৈষ্ঠ, শোলোই ডিসেম্বর, পোঁচিশে বৈশাখ প্রভৃতি।] ভুল: ২৭ মে ২০২৫ → শুদ্ধ: ২৭শে মে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ/খ্রি. [এটি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি। বাংলায়: খ্রিষ্টাব্দ, সংক্ষেপে: খ্রি.] ভুল: ঈদ-উল-আযহা → শুদ্ধ: ইদুল-আজহা [সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান।] ভুল: উপলক্ষে → শুদ্ধ: উপলক্ষ্যে [লক্ষ্য থেকে উপলক্ষ্য, লক্ষ থেকে উপলক্ষ হয় না। উপলক্ষ্য, বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ২১২।] ভুল: ১৪-১৮ জুন → শুদ্ধ: ১৪ই-১৮ই জুন [প্রাগুক্ত]
ভুল: ১৪-১৮ জুন ২০২৫ তারিখ → শুদ্ধ: ১৪ই জুন থেকে ১৮ই জুন ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ/তারিখ [তবে একই সঙ্গে খ্রি. ও তারিখ লেখা বাহুল্য। যেমন: ২৭শে মে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখ] ক্লাশ → ক্লাস [সূত্র: বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৩৪৭।]
(ড. মোহাঃ তৌহিদুল ইসলাম) → ড. মোহাঃ তৌহিদুল ইসলাম [অতিরিক্ত তথ্য বা ব্যাখ্যার জন্য বন্ধনীর ব্যবহার করা হয়। যেমন: রেজিস্ট্রার ড. মোহা. তৌহিদুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত)]। বিতরণঃ → বিতরণ: [প্রাগুক্ত] এন্ড → অ্যান্ড [‘এন্ড’ (end) এবং ‘অ্যান্ড’ (and)—এই দুটি শব্দ দেখতে এবং উচ্চারণে কিছুটা মিল থাকলেও, এগুলোর অর্থ ও ব্যবহার একেবারেই আলাদা। ‘এন্ড’ অর্থ: শেষ, সমাপ্তি, অবসান। ‘অ্যান্ড’ অর্থ: এবং, ও]।
এ্যানিম্যাল → অ্যানিম্যাল [বাংলা উচ্চারণে রোমান a-বর্ণের /æ/ উচ্চারণরূপের বাংলা প্রতিবর্ণ হলো অ্যা বা ্যা। রোমান ‘a’-এর প্রতিবর্ণীকরণ বর্ণপদ্ধতিতে হয় না, ধ্বনিপদ্ধতিতে হয়। ইংরেজি বা ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি শব্দের উচ্চারণে যদি /æ/ ধ্বনি থাকে তাহলে বাংলা বানানে অ্যা বা ্যা-কার হবে। অন্যথায় হবে না।]
বায়োকেমিষ্ট্রি → বায়োকেমিস্ট্রি [এটি বিদেশি শব্দ। বিদেশি শব্দে ‘ষ’ ‘ী’ ইত্যাদির ব্যবহার হয় না।]
হিসাব বিজ্ঞান → [হিসাববিজ্ঞান এখানে ‘হিসাব’ এবং ‘বিজ্ঞান’ দুটি আলাদা শব্দ, যেগুলোকে আলাদাভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ, ‘হিসাব’ (যা গণনা বা হিসাবের কাজ বোঝায়) এবং ‘বিজ্ঞান’ (যা শাস্ত্র বা বিজ্ঞান বোঝায়) শব্দ দুটি আলাদাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। হিসাববিজ্ঞান—বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন, হিসাব রক্ষণ, বাজেট তৈরি, হিসাব ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কিত শাস্ত্র।] ইংরেজী → ইংরেজি [প্রাগুক্ত]
শহীদ → শহিদ [‘শহিদ’ শব্দটির উৎস আরবি অর্থাৎ বিদেশি। নিয়মানুযায়ী বিদেশি উৎসের বাংলা শব্দের বানানে ই/ই-কার হয়। সেজন্য ‘শহিদ’ বানানটি ই-কার দিয়ে শুদ্ধ অর্থাৎ শুদ্ধ বানানটি হবে ‘শহিদ’।] পরিবহন → পরিবহণ [সংস্কৃত ও বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘পরিবহন’ বানান অশুদ্ধ এবং ‘পরিবহণ’ বানান শুদ্ধ।]
মেডিকেল → মেডিক্যাল [বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, একমাত্র প্রমিত বানান মেডিক্যাল (Medical)। কারণ, Medi= মেডি; cal= ক্যাল। ইংরেজি a বর্ণের বাংলা লিপ্যন্তর: অ্যা। তাই, মেডিকেল অশুদ্ধ লিপ্যন্তর। একমাত্র শুদ্ধ ও প্রমিত লিপ্যন্তর: মেডিক্যাল।]
একাডেমিক → অ্যাকাডেমিক [প্রাগুক্ত] কেন্দ্রিয় → কেন্দ্রীয় [বাংলায় ‘কেন্দ্র’ শব্দের সাথে বিশেষণ গঠনের জন্য যে প্রত্যয় যোগ হয়, তা হলো ঈয়। এখানে: ‘কেন্দ্র’ + ‘ঈয়’ = কেন্দ্রীয়] (জ্ঞাতার্থে/কার্যার্থে)ঃ → (জ্ঞাতার্থে/কার্যার্থে): [প্রাগুক্ত]
এছাড়া নোটিশে যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার লক্ষ করা যায় না এবং কিছু শব্দের মাঝে এক বর্ণের চেয়েও বেশি ফাঁকা রয়েছে।
ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগের শিক্ষার্থী হিমু বলেন, ‘এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এমন ত্রুটি এড়াতে প্রুফরিডিং সেল গঠন কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় এসেছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার বলেন, ‘যারা টাইপ করেছে, তারা হয়তো ভুলগুলো খেয়াল করেনি। সাধারণত এসব নোটিশ অ্যাকাডেমিক শাখা দেখে থাকে। আমি বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলব।’
অন্যদিকে, অ্যাকাডেমিক শাখার উপরেজিস্ট্রার মো. মাকসুদুল রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, একটি নোটিশে এতগুলো বানান ভুল কীভাবে সম্ভব? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা পুরোনো ফরম্যাটে করা হয়েছে।
দু-একটি বানান ভুল থাকতে পারে। আমরা সাধারণত আগের ফরম্যাট ব্যবহার করি, শুধু ওপরের অংশটা সংশোধন করে যাদের কাছে পাঠাতে হয়, তাদের কাছে পাঠিয়ে দিই। সাধারণ শাখাও এভাবে দেয়।’
পুরোনো ফরম্যাটে প্রস্তুত করা নোটিশ ভবিষ্যতে সংশোধন করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। এগুলো সংশোধন করে নেওয়া হবে। এটি সংশোধনযোগ্য।’