পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগসহ বিভিন্ন পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করছেন দিনাজপুরের নারী উদ্যোক্তা শিউলি আক্তার জুথি (৩৫)। পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদার পাশাপাশি স্থানীয় ৩৫ জন বেকার নারীর কর্মসংস্থানও হয়েছে। এ নারী উদ্যোক্তার পাটের তৈরি হস্তশিল্পের নাম রেখেছেন জুট ওয়ার্ল্ড। তার এ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রপ্তানিতে সারা পাচ্ছেন।
এই নারী উদ্যোক্তা দিনাজপুর সদরের আউলিয়াপুর ইউনিয়নের করিমুলস্নাপুর গ্রামের নিজ বাড়িতেই পরিবেশ বান্ধব পাটের বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করে মাসে এখন তার আয় হচ্ছে ৫০ হাজার টাকার অধিক। এ ছাড়া শিউলি আক্তার জুথি জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও পাঠাচ্ছেন তার উৎপাদিত পণ্য।
দিনাজপুর সদরের করিমুলস্নাপুর গ্রামের আব্দুল জব্বারের মেয়ে নারীর উদ্যোক্তা শিউলি আক্তার জুথি। ২০১৭ সালে দুটি মেশিন আর মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে পাটের তৈরির বিভিন্ন ব্যাগ, মেয়েদের পার্স, ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল ব্যাগ, ফাইল ব্যাগ, শোপিস, ওয়াল হ্যাংগার, মোবাইল সেট রাখার ব্যাগ, শিখা, কলমদানি, ফুলদানি, টেবিল রানার সেটসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি শুরু করেন। প্রথম দিকে তেমন সাড়া না পেলেও এখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ে পাটের তৈরি এসব পণ্যের অর্ডার পাচ্ছেন। এখন প্রতিষ্ঠানে আটটি মেশিনসহ প্রায় ৩৫ জন নারী পাটের হস্তশিল্প তৈরি করছেন এবং নিজেরাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
নারী উদ্যোক্তা শিউলি আক্তার বলেন, ২০০৩ সালে সবসময় বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকার সাভারে বসবাস করতেন। আর্থিক অনটনের কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। বাবার পছন্দে ২০০৩ সালে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের কিছুদিন পর একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। মেয়ের বয়স তিন বছর হওয়ার পর তার সংসার আর টেকেনি। এরপর থেকেই শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। বাবার সংসারে মেয়েসহ বোঝা হয়ে দাঁড়ান। তখন নিজ থেকে উদ্যোগ নেন কিছু করার। সেই চিন্তা থেকেই দর্জির কাজ শুরু করেন। তবে পাটের তৈরি পণ্যের প্রতি তার আলাদা দরদ ছিল। সাভারের যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের উপর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালে নিজ জেলা দিনাজপুরে এসে বাড়িতেই দুটি মেশিনের মাধ্যমে পাটের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা শুর করেন। ধীরে ধীরে কাজের ব্যাপকতা বাড়ে। গ্রামের দুই চারজন বেকার মহিলাকে নিয়ে কাজটা শুরু করেন। এখন তার এখানে গ্রামের ৩৫ জন নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে তিনি অফলাইন এবং অনলাইন দুই মাধ্যমে অর্ডার পাচ্ছেন। এখন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যক্তি তার উৎপাদিত পাটের তৈরি পণ্য নিচ্ছে। এখন নিজেকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা মনে করতে শুরু করেছেন। দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এখন তিনি নিজেই প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেন। এতে করে নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হচ্ছে, পাশাপাশি তার কাজের পরিধি ও পরিচিতি বাড়ছে।
শিউলি আক্তার জুথির জুট ওয়ার্ল্ড কারখানায় কাজ করতে আসা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, জুথির কারখানায় কাজ করে মাসিক কিছু টাকা আয় করতে পারছেন, যা নিজের হাত খরচ, ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, পাশাপাশি স্বামীর সংসারেও কাজে লাগছে। নিজের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। মাসুমা আক্তার নামে এক কর্মী বলেন, 'গত তিন বছর ধরে শিউলি আপার কারখানায় কাজ করছি আর শিখছি। এখন অনেক কিছু নিজে তৈরি করতে পারি। নিজের মধ্যে এখন আত্ম কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্পৃহা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আমি নিজেই কর্মসংস্থানের তৈরি করে আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছি।'
দিনাজপুর যুব উন্নয়নের উপপরিচালক রওনকুল হাসান বলেন, পস্নাস্টিকের পরিবর্তে পাটজাত পণ্য ব্যবহার করা সরকারের প্রচেষ্টা। সেই পাটজাত পণ্য তৈরি করে শিউলি আক্তার জুথির মতো অনেকেই দিনাজপুরে ছোট ছোট কুটির শিল্প ও হস্তশিল্প তৈরি করছেন। আমরা পাটজাত পণ্য তৈরির কাজে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। একই সঙ্গে স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছি। এতে করে দেশের বেকার যুবক-যুবতীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে।