শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
ইতিহাস-ঐতিহ্যের পৌষ-সংক্রান্তি

জামাই-শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতার মাঠ বিনিরাইল!

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি
  ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
জামাই-শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতার মাঠ বিনিরাইল!
.

গাজীপুরের কালীগঞ্জের বিনিরাইল গ্রামের ফসলের জমিতে প্রতি বছরের মতো এবারও বসেছে আড়াইশ বছরের পুরনো মাছের মেলা। এটি মূলত মাছের মেলা হলেও সবাই একে জামাই মেলা বলেই জানে। বিনিরাইল ও আশপাশের গ্রামের জামাইরা এ মেলার মূল ক্রেতা। জামাইরা যেমন বড় মাছ কিনে শ্বশুর বাড়ী নিয়ে যাওয়ার জন্য মেলায় আসেন, তেমনি শ্বশুররাও জামাইকে মেহমানদারী করার জন্য বড় মাছ কিনতে আসেন। মেলা যেন জামাই-শ্বশুরের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতার মাঠ। বিনিরাইল গ্রামে প্রতিবছর অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। মেলা প্রাঙ্গণে সকাল থেকেই বসেছে সারি সারি মাছের দোকান। সামুদ্রিক বড় মাছের পাশাপাশি এখানে দেশীয় প্রজাতির নানা মাছের সমাহার। মাছের মেলায় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি ও সুরে সুরে হাঁক ডাক করছেন দোকানীরা। বড় মাছ মাথার উপরে তুলে জানান দিচ্ছেন মেলার বড় মাছটি তিনি এনেছেন। দোকানীরদের এমন চটকদারিতে ক্রেতারাও ঝুঁকছেন স্টলগুলোতে। মেলায় ৩ শতাধিক মাছের স্টল ছাড়াও রয়েছে আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি, নিমকি-মোরালি, হাওয়াই মিঠাই, বস্ত্র, হস্ত ও কুটির শিল্পের নানা পণ্যেরও বাহার। কথিত আছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনাকে ঘিরে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে ১৮ শতকে মেলাটির প্রচলন হয়। মূলত মাছ মেলা হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়। প্রতি বছর মেলাকে কেন্দ্র করে বিনিরাইল ও আশপাশের কয়েক গ্রামের শ্বশুররা তাদের মেয়ের জামাইকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানায়। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। জামাইরা মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যায়। এ মেলা জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়। তবে এখন শ্বশুররাও মেলা থেকে বড় মাছ কিনে জামাইদের জন্য কিনে নিয়ে যান। কথা হয় মেলায় ঘুরতে আসা কয়েকজন ঘুরতে কয়েকজন দর্শনার্থীর সাথে। তারা জানান, মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাইকে দাওয়াত করে আনা এই এলাকার মানুষের রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এই মেলায় দল বেঁধে বন্ধু-বান্ধ নিয়ে তারা ঘুরতে আসেন। অনেক লোক সমাগম হয় তাই খুব ভাল লাগে। কেউ কেউ আবার জানান, তারা একেবারেই নতুন। এ মেলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি ভাইরাল, তাই দেখতে আসছেন। মেলাকে ঘিরে বিনিরাইলের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। মেলার মাছ ব্যবসায়িরা জানান, প্রতিবছরই এই মেলায় তারা আসেন। অন্য বছর বেচাকেনা ভালো থাকলেও এবারের বেচাকেনা খুবই মন্দা ভাব যাচ্ছে। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ বিক্রি করেন। মেলায় কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভিড় বেশি। তবে বেচা-কেনা যাই হোক স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে প্রতি বছরই আসেন বিক্রেতারা। সাধারণত এ অঞ্চলের জামাইরা তাদের শ্বশুর বাড়িতে নিমন্ত্রন পেয়ে বেড়াতে এসে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি যান। আবার শ্বশুরও বড় মাছ কিনে জামাইদের সমাদর করেন। ব্যবসার পাশাপাশি জামাই শ্বশুরের এই যুদ্ধ দেখতে বেশ ভালো লাগে। কথা মেলায় মাছ কিনতে আসা এলাকার কয়েকজন জামাই ক্রেতার সঙ্গে। তারা জানান, তারা এ উপজেলায় বিয়ে করেছেন। প্রতিবছরই এ মেলা উপলক্ষে দাওয়াত করা হয়। এবারও শ্বশুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে বৌ নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আর বেড়াতে আসলেই মেলা থেকে বড় মাছ কিনে শুশ্বর বাড়িতে যান এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ মেলা তাদের মিলন জন্য মেলা বলেও জানান তারা। আয়োজকরা জানান, শুরুতে মেলা অনুষ্ঠিত হতো ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। এটি এক সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মেলার হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে আয়োজন করে আসা বিনিরাইলের মেলার বয়স আড়াইশ' বছর ছাড়িয়েছে। তাই বেড়েছে মেলার পরিধিও। মেলাটি এখন স্থানীয়দের কাছে ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা গাজীপুর জেলার সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবেও স্বীকৃত। কালীগঞ্জ থানার ওসি মো. আলাউদ্দিন বলেন, অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তিতে প্রতি বছর বিনিরাইল গ্রামে এই মাছের মেলার আয়োজন হয়। সাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে মেলায় থানা পুলিশ ও আনসার সদস্যের টহল থাকবে। এছাড়াও মেলায় কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য মেলা প্রাঙ্গণে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। কালীগঞ্জ ইউএনও তনিমা আফ্রাদ বলেন, বিনিরাইলের মাছের মেলাটি স্থানীয় একটি ঐতিহ্য। বহু বছরের পুরনো এই মেলাকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে রয়েছে নানা ধরণের কথা। তবে ইতিহাস ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে গ্রাম-গঞ্জে এ ধরণের আয়োজন সত্যি আমাদের চিরায়ত বাংলার রূপই ফুটে উঠে। বিভিন্ন স্থানে পৌষ সংক্রান্তি পালিত লাখাই (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে পিঠাপুলির আমেজে ও উৎসবমুখর পরিবেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি পালিত হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্যে ছিল খড়- বাঁশ দিয়ে তৈরি বেড়াঘরে আগুন দেওয়া এবং বাড়ি বাড়ি কীর্তনসহ হরেক রকমের খাদ্য সামগ্রী হরিলুট। দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার দুর্গাপুরে হাজং সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী দেউলী পৌষ উৎসব উদযাপিত হয়েছে। সোমবার বিকালে বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি হলরুমে উৎসবের উদ্বোধন করেন আদিবাসী লেখক ও গবেষক মতিলাল হাজং। পরে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, দেউলী পূজাসহ নানা আয়োজন হয়।ইউনেস্কো ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে এবং আদিবাসী কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার আয়োজনে এ উৎসবে পাহাড়ের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা অংশ নেন। কবি দোলন হাজং ও মনীষা হাজংয়ের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন আদিবাসী কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কবি মং এ খেন মংমং। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিরিশিরি ডনবস্কো কলেজের পরিচালক ফাদার পাওয়েল কুচওয়ালিক। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক গীতিকবি সুজন হাজং। এ ছাড়াও বক্তব্য দেন ইউএনও নাভিদ রেজওয়ানুল কবীর, জাতীয় জাদুঘরের কিপার আসমা ফেরদৌস, শিক্ষক মণীন্দ্রনাথ মারাক, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং, বিপুল হাজং, নারীনেত্রী সন্ধ্যা রাণী হাজং, চিত্রশিল্পী ও গাঁওমোড়ল বিশ্বজিৎ হাজং রূপক, কবি জন ক্রসওয়েল খকশি। গীতিকবি সুজন হাজং বলেন, 'হাজংরা উৎসবমুখর জাতি। হাজংদের অধিকাংশ উৎসব বিলুপ্তির পথে। তাদের ধর্মীয় ও কৃষিভিত্তিক উৎসবগুলোর মধ্যে দেউলী পৌষ উৎসব অন্যতম।' কবি মং এ খেন মংমং বলেন, 'হাজংদের নিজেদের আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি চর্চা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে।' ফাদার পাওয়েল কুচওয়ালিক বলেন, 'সংস্কৃতিবান জনগোষ্ঠী হিসেবে হাজংরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। আমি বিশ্বাস করি, হাজং সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে দেউলী উৎসব উদযাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।' আলোচনা শেষে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজং শিল্পীরা নৃত্য ও গান পরিবেশন করেন। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও দেউলী পূজা অর্চনা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে