মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

কয়েক কোটি টাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে ঝুলছে তালা

সদরপুর (ফরিদপুর) প্রতিনিধি
  ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কয়েক কোটি টাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে ঝুলছে তালা
আকোটেরচর ও ঢেউখালী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর -যাযাদি

ফরিদপুরের সদরপুরে গৃহহীন ভূমিহীন ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিগত শেখ হাসিনা সরকার গড়ে তোলে শত শত লোকের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প নির্মাণ করা হলেও সিংহভাগ বাসিন্দারা ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের ছেড়ে যাওয়ায় ওই ঘরগুলোতে এখন ঝুলছে তালা। তালা ভেঙে শূন্য গৃহে গরু ছাগলের লালন পালন শুরু করেছেন আশ্রয়ণের অনেক বাসিন্দা। ছেড়ে যাওয়া গৃহে নতুন উপকারভোগী অনুমোদন না দেওয়ায় ঘরগুলো নষ্ট হয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প এখন ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।

২০২৩ সালের দিকে প্রায় ঘরের উপকার ভোগীদের ঘরের চাবি, কবুলিয়ত দলিল, নামজারি খতিয়ান, ডিসিআরসহ যাবতীয় কাগজপত্র হস্তান্তর করে সদরপুর উপজেলা প্রশাসন। হস্তান্তরের কয়েক মাস পেরিয়ে যেতে না যেতেই একের পর এক পরিবারগুলো আশ্রয়ণ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, গৃহ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে স্বল্প মূল্যের কাঠ ও টিন। দরজা, জানালায়ও ব্যবহার করা হয়েছে পাতলা পেস্ননসিট। ইটের গাঁথুনিতে সিমেন্ট বালুর পরিমাণ কম থাকায় দেয়ালে ক্রুটি ও ফাটল দেখা দিয়েছে। মাটি ভরাট করে ঘরের ভিটা উঁচু না ফসলী ক্ষেতের নিচু জায়গায় প্রকল্প তৈরির কারনে বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতে আশ্রয়ণে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাল হচ্ছে আশ্রয়নে থাকা বাসিন্দারা। গৃহ সমতল হওয়ায় সামান্য পানি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মলমুত্র ত্যাগের ট্যাংকি ভরাট হয়ে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। দুগন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি মলমুত্র ছড়িয়ে পানিবাহিত বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আশ্রয়ণের বাসিন্দার।

নানা সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জানালেও প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা মিলছে না বলে ক্ষুদ্ধ আশ্রয়ণের বাসিন্দারা। আরও দেখা যায়, আকোটেরচর প্রকল্পের অনেক ঘরের ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। ঘরের মেঝের বালু সরে যাওয়ায় খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে টিনের ঘরগুলো। দেখভাল না থাকার কারণে চুরি হয়ে যাচ্ছে ঘরের দরজা জানালা।

এ ব্যাপারে আকোটেরচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা তারা মিয়ার ভাষ্য, আকোটেরচর সবচেয়ে বড় আশ্রয়ন। এখানে অর্ধেক ঘর খালি পড়ে আছে। যারা এসেছিলেন তারা ঘরে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন। এখন অধিকাংশ ঘরে বাসিন্দা নেই। সরকারি কোনো অনুদান এলে তারা আসেন। ঘর প্রসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, ওই সময় অনেক ঘর উঠানোর শুরুতেই ভেঙ্গে পড়েছে। ওই সময় কোনো মতে ঘরগুলো রেখে যায়।

একই আশ্রয়নের বাসিন্দা শাহিন শিকদার জানান, অনেকে ঘরে তালা মেরে চলে গেছে। খালি ঘরে এখন গরু, ছাগল পালন করা হচ্ছে। এতে করে ঘরগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ঢেউখালী হরিন্যা আশ্রয়ণের বাসিন্দা সুমন মাতুব্বর জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও এখন দুর্ভোগের শেষ নেই। ঘরে বসবাসে নানা অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতে কাঁদা-পানিতে একাকার হওয়ায় প্রকল্প এলাকার ঘরের ভেতর ও টয়লেটে পানি জমে থাকছে। এর ফলে বাসিন্দাদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ঘরগুলো। তাদের সমস্যা সমাধান না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েই অনেকই ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

স্থানীয় অফিস সূত্রে জানা যায়, সদরপুর উপজেলায় ২০১৮ ও ২০১৯ সাল থেকে একের পর এক আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ শুরু হয়। উপজেলার ৯ ইউনিয়নের মধ্যে প্রকল্পের আওতায় রয়েছে, কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের নয়াকান্দি, ঠেঙ্গামারী, পূর্বকান্দি, সদরপুর ইউনিয়নের পূর্বশ্যামপুর ভূবনেশ্বর নদীর পাড়,বাইশরশি বাবুবাড়ি জমিদার বাড়ি, আকোটেরচর গুচ্ছগ্রাম, আকোটেরচর বটতলা, ঢেউখালী ইউনিয়নের হরিন্যা, ভাষানচর ইউনিয়নের কারীরহাট, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর, খেজুরতলা। উপজেলায় রয়েছে তিন ধরনের ৭১৮টি ঘর। এসব ঘরের ধাপে ধাপে বরাদ্দ মূল্য ছিল পঁচাত্তর হাজার, একলাখ বিশ হাজার ও একলাখ একাত্তর হাজার টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দার ভাষ্য, ওই সময় স্থানীয় রাজনৈতিক ও এলাকার স্থানীয় কিছু দালাল চক্রের কারনে প্রকৃত ভূমিহীন,গৃহহীন ও গরীব মানুষের মধ্যে ঘর বিতরণে অনিয়ম হয়েছে। প্রকৃত গরীব ঘর পেলে এরকম হতো না। যার কারণে ওই সময় ঘর নিয়ে এখন গোপনে স্ট্যাম্পে বিক্রি করে দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। তাদের চলে যাওয়ার কারণে এখন আশ্রয়নের অধিকাংশ ঘরে ঝুলছে তালা। বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো খোঁজ নিতে আসেন না বরাদ্দ পাওয়া উপকার ভোগীরা।

আকোটেরচর আশ্রয়ণের আরেক বাসিন্দা আয়নাল হোসেন জানান, 'আমি পাঁচ বছর ধরে বসবাস করি। অনেক ঘরে দরজা, জানালা নেই। এগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। একসারিতে ৬০টি ঘর উঠলেও এখন কোনো ঘরেই লোক নেই। আমরা গরীব মানুষ। অনেক সময় ভয়ে থাকি চোর ডাকাতের। আশ্রয়ণের সব ঘরে লোক থাকলে আমরা চোর ডাকাতের হাত থেকে রেহাই পেতাম।'

সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা জানান, 'আমি সদ্য সদরপুরে এসেছি। এ ব্যাপারে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে