বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

হাওড়ের কান্দায় ৬ মাসের গ্রাম মুখশেদপুর

মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
হাওড়ের কান্দায় ৬ মাসের গ্রাম মুখশেদপুর
হাওড়ের কান্দায় ৬ মাসের গ্রাম মুখশেদপুর

বিস্তীর্ণ হাওড়ের কান্দায় জিরাতিদের (কৃষি শ্রমিক) ঘর সমূহ আদতে কুঁড়েঘর। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, সবুজের বুকে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো ঘর। বাঁশের বেড়া আর শন দিয়ে ছাওয়া এসব ঘর তৈরি করে প্রতি বছরই কার্তিক্তঅগ্রহায়ণ মাসে মধ্যনগর উপজেলার জিরাতিদের গ্রাম মোখসেদপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন ওই গ্রামের ও বাইরের বিভিন্ন গ্রামের  লোকেরা। তবে হাওড়ে খাদ্য উৎপাদন ও পশু পালনের মাধ্যমে কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা জিরাতিদের অবস্থা এখন আগের মতো নেই। তাদের কথা ভাবার জন্যও নেই কেউ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ সুবিধা বিহীন দুর্গম হাওরের কান্দায় ছয় মাসের গ্রাম মুখশেদপুর যেনো দেশের ভেতর আরেক দেশ।

মুখশেদপুরকে গ্রাম বলা হলেও আদতে সেখানে ছয় মাস কোনো জনবসতি থাকে না। তবে হাওরের বোরকৃষি মৌসুমে জমজমাট এক জনবসতির দেখা মিলে এখানে।

জানা যায়, জিরাত একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ শর্ত সাপেক্ষে চাষযোগ্য জমি। যারা এই নিয়মে শর্ত সাপেক্ষে জমি চাষ করেন তাদের বলা হয় জিরাতি। প্রাচীনকাল থেকেই হাওরের বিস্তৃত অনাবাদি জমি স্থানীয়রা একা চাষ করতে পারতেন না। ফলে শর্ত সাপেক্ষে অন্য এলাকার কৃষকদেরও কিছু জমি চাষ করতে দেওয়া হতো। সেই কৃষকরা জিরাতি নামে পরিচিত।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, একসময় প্রতিবছর কার্তিক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার কৃষক সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওরে জিরাত করতে আসতেন। বিস্তৃত হাওরের বুকে নদীর তীরে খোলা আকাশের নিচে বাঁশ, বেত, শন ইত্যাদি দিয়ে তারা অস্থায়ী ঘর তৈরি করেন। এই ঘরে গবাদিপশুসহ জিরাতিরা বসবাস করেন। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা চাল, নদী থেকে ধরা মাছ এবং জমি থেকে তোলা সবজি রান্না করেই তারা দিনাতিপাত করতেন।

মধ্যনগরের জিরাতি গ্রাম মুখশেদপুরে এবছর ঘর বেঁধেছেন ৪৮ জিরাতি পরিবার। গুরমার হাওরের সঙ্গেই এসব জিরাতিদের গভীর হৃদ্যতারসখ্য। আর এ কারণেই ক্তিনা তারা ঘরও বাঁধেন হাওরপাড়েই ছয় মাসের জন্য। শন দিয়ে ছাওয়া অস্থায়ী ঘরেই থাকেন স্বামী স্ত্রী্তসন্তান নিয়ে। হাওড়ের এক চিলতে চরের বুকেই কাটাতে হয় বছরের ছয়টি মাস। খরতাপে-রোদে পোড়েন আর বৃষ্টিতে ভেজেন মানুষসহ গরু ছাগল সব প্রাণি। তবুও গোটা বছরের একমাত্র সম্বল বোরো ফসল ফলিয়ে গন্তব্যে ফেরেন বৈশাখ মাসে।

মুখশেদপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বছর তিনেক ধরে ফসলের মুখ দেখলেও এর আগে একযুগ প্রায় আগাম পাহাড়ি ঢল এসে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে জিরাতিদেরও সর্বস্বান্ত করে ফেলেছিল। তাই গত কয়েক বছরে গুরমার হাওরে জিরাতিদের আসা অনেকটাই কমেছে।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, মধ্যনগর উপজেলার সীমান্তবর্তী বংশীকুন্ডা উত্তর ইউনিয়নের বাকাতলা গ্রাম থেকে মুখশেদপুরে স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে এসেছেন শংকর সরকার। তার পরিবারসহ ৩৯টি পরিবার এসেছে বাকাতলা গ্রাম থেকে। একই ইউনিয়নের কলতাপাড়া গ্রাম থেকেও এসেছে আরও কয়েকটি পরিবার। কলতাপাড়া গ্রামের জিরাতিদের নিজের জমা্তজমি নেই, অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করেন। পাশের ধর্মপাশা উপজেলার কয়েকটি পরিবারসহ সব মিলিয়ে বিভিন্ন এলাকার ৪৮ জিরাতি পরিবারের বসতি এ বছর মুখশেদপুরে। 

শংকর দাস জানান, বাঁশের বেড়া আর শন দিয়ে ছাওয়া এসব ঘর তৈরি করে গত সাত্তআট বছর ধরে প্রতি কার্তিক মাসে এই গুরমার হাওড়ে আসেন তারা। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে নেমে পড়েন বোরো জমি আবাদে। তাদের কারো দল বড়। কেউ কেউ ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ধানের চারা রোপণ করেন। নিজেদের জম্তিজিরাত চাষবাসের পাশাপাশি অবস্থা সম্পন্ন কৃষকদের কাছ থেকেও অনেকেই জমি বর্গা নেন। জিরাতিরা এবার গুরমার হাওরে প্রায় ৩০০ বিঘা জমি আবাদ করছেন।

প্রবীণ জিরাতি সুধন্য মলিস্নক বলেন, 'কি করি, বাপ্তদাদার জমিন ছাইড়া যাইতে মন চায় না। তাই হত্যি (প্রতি) বছরে এমুন সময় আই (আসি)। জিরাত করে যাই পাই লইয়া যাই।'

তিনি আরও জানান, ৫০-৬০ বছর আগে এখানে তদের বাপ্তদাদার ভিটা ছিল। হাওড়ের ঢেউ আর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় বছরের পর বছর বাড়ি্তভিটা রক্ষার সংগ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পেরে না উঠে গ্রাম ছাড়েন তারা। এছাড়াও চোর-ডাকাতের অত্যাচার ছিল মুখশেদপুরবাসীর গ্রাম ছাড়ার আরেক কারণ। এসব কারণেই মুখশেদপুর গ্রাম শুধু নামেই রইল গ্রামটি হারিয়ে গেলো হাওড়ের বুকে। অবশ্য ছেড়ে যাওয়ার কয়েক বছরপর থেকেই তারা জিরাতি হিসেবে মুকশেদপুরে আসতে শুরু করেন। তবে স্থায়ী বসতি স্থাপনের চিন্তা আর করেননি কেউ।

কলতাপাড়া থেকে দুই ছেলে ও স্ত্রীসহ এসেছেন জিরাতি আব্দুল মজিদ। প্রায় তেরো বিঘা জমিতে বোরোধানের আবাদ করেছেন। তিনি জানান, এখন আগের মতো অবস্থা নাই। হাওড়ের পানি দিনে দিনে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। নলকূপ বসিয়েও ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি তোলা যায় না। তাই খাবার পানির সংকট বাড়ছে। এই কয়দিনে দুইটা নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। তারা চাঁদা তুলে নতুন নলকূপ বসানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। ইজারদারের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় হাওড়ে আগের মতো মাছ ধরার সুযোগ নেই। ফলে পরিবারের সদস্যদের আমিষের ঘাটতি পূরণ করা যায় না। দিন দিন এসব সংকট বাড়ছে। তাই আগের মতো জিরাতিরা আসছে না। এতে অনেক জমি পতিত থেকে যাচ্ছে প্রতি বছর।

ইউএনও উজ্জ্বল রায় বলেন, 'জিরাতিরা আমাদের দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের  জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু তারা রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে তেমন সুযোগ সুবিধা পান না। সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে মুকসুদপুরের জিরাতিদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, তাদের জীবনমানের উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে