পবিত্র রমজান মাস আসতে না আসতে শুরু হয়েছে সয়াবিন তেল নিয়ে কারসাজি। গোডাউনে মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নেওয়া হচ্ছে চড়া দাম। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন ক্রেতারা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নবীগঞ্জে ডিলারদের গোডাউনে বোতলজাত সয়াবিন তেল মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় বাজারে ছড়া মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে সয়াবিন তেল। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যাচ্ছে সয়াবিন তেল'সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আসন্ন মাহে রমাদান'কে সামনে রেখে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল এর হঠাৎ সংকট দেখা দিয়েেেছ। এ ব্যাপারে দ্রম্নত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান জরুরী বলে দাবী ভুক্তভোগীদের।
মাহে রমাদান আসতে না আসতেই হঠাৎ সয়াবিন তেলের মূল্য আকাশচুম্বি হওয়ায় সাধারণ মানুষরা পড়েছেন বিপাকে। নবীগঞ্জ উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন হাটবাজারের দোকানে প্রয়োজনের তুলনায় বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। ডিলাররা তেল গুদামে মজুত করে বাজারে তীব্র সংকট সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ সাধারণ ব্যবসায়ীদের।
সূত্রে জানা যায়, রমজান মাসকে সামনে রেখে নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সয়াবিন তেল নিয়ে ফের তেলেসমাতি শুরু হয়েছে। গত এক মাস ধরে নবীগঞ্জের বিভিন্ন হাট-বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরী করা হয়েছে। দোকানে দোকানে ঘুরে সহজে মিলছে না সয়াবিন তেল। মিললেও অনেক ব্যবসায়ী সয়াবিন তেলের সংকট দাবি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন বাড়তি দাম। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঘটছে বাদানুবাদ। অভিযোগ রয়েছে- অনেকেই তেল বিক্রি না করে মজুদ করছেন রমজান মাসে বেশি দামে বিক্রির জন্য। ক্রেতাদের অভিযোগ, সয়াবিন তেলের সঙ্গে চিনিগুড়া চাল, ময়দা, লবন, ডালসহ অনান্য পণ্য কিনতে বাধ্য করছে ব্যবসায়ীরা। অন্য পণ্য না নিলে বিক্রেতারা শুধু সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন না। এর ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।
নবীগঞ্জ পৌর শহরসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মুদি দোকানের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু দোকানে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। যেসব দোকানে তেল পাওয়া যায় তারা ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০-২১০ টাকায় বিক্রি করেন। কোন কোন দোকানে ১ লিটার তেলের বোতল নেই। শুধু ৫ লিটার, তাও ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ টাকায় বিক্রি করার কথা। পৌর এলাকার আব্দুল করিম নামে এক ক্রেতা জানান- প্রায় দেড় মাস ধরে ডিলাররা তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। তেলের সংকট ও দাম বেড়েছে। এছাড়া চাল-ডাল-ময়দাসহ অন্যান্য পণ্য অবিক্রিত থাকায় তেলের সঙ্গে সেসব পণ্য নিতে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। অন্যান্য পণ্য না কিনলে তেল দিচ্ছে না।
আব্দুল মন্নান নামে এক ব্যক্তি জানান- আসন্ন রমজানের আগে কৌশলে তেলের সংকট তৈরি করে আবারও দাম বৃদ্ধির পায়তারা ডিলারগণ, বোতলের গায়ে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা দিয়েও অনেক জাগায় তেল মিলছে না। সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় আমরা খুব কষ্টে আছি।
এদিকে রমজানের আগেই বাজারে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন সচেতন মহল। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বোতলজাত সয়াবিন তেলের ডিলারগণ, প্রয়োজনীয় তুলনায় তেল দিতে পারছেন না। যতটুকু দিচ্ছেন, তার সঙ্গে ধরিয়ে দিচ্ছেন চাল, আটা ও সরিষার তেল। আর এ সব পণ্য না আনলে সয়াবিন দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া মুল্যে সয়াবিন ক্রয় করে গ্রাহকদের দিতে হয়।
নবীগঞ্জ শহরে তীর, ফ্রেশ, পুষ্টি সয়াবিন তেলসহ বিভিন্ন কোম্পানীর ডিলার রয়েছেন। চলতি মাসে বাজারে ফ্রেশ সয়াবিন পাওয়া যায়নি বললেই চলে। ফ্রেশ তেলের ডিলার কাজল রায় গুদামে তেল মজুদ রেখেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সকল কোম্পানীর ডিলারগণই সয়াবিন তেলের সঙ্গে অন্যান্য পণ্য ধরিয়ে দেন। এ ব্যাপারে ফ্রেশ কোম্পানীর ডিলার কাজল রায় বলেন, কোম্পানী চাহিদা মতো তেল দিতে পারছেন না। চলতি মাসে ৭শ' কার্টন তেলের মধ্যে ৫শ' কার্টন দেওয়া হয়েছে। ওই কোম্পানীর জেলা টিএম খোকন বেপারী বলেন, চাহিদা অনুযায়ী ডিলাদের তেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যা দিচ্ছেন তা বাজারজাত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, বিষয়টি সর্ম্পকে অবগত রয়েছেন এবং দ্রম্নত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
উলেস্নখ্য- বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা ৩ লাখ টন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য নিম্নমুখী। এ অবস্থায় দেশে ভোজ্যতেলের সংকটের কোনো কারণ নেই। তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরিকারীদের দ্রম্নত আইনের আওতায় আনার আহবান সচেতন মহলের।
মধুখালী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, রমজানের আগেই ফরিদপুরের মধুখালীতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। খুচরা বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছে। দোকানিদের অভিযোগ সংকটের জন্য দায়ী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রায় দুই মাস ধরে কোম্পানি থেকে সয়াবিন তেল পাচ্ছি না। পুষ্টি গ্রম্নপের মধুখালীর ডিলার রেজাউল করিম জানান, আমরা অর্ডার দিয়ে রেখেছি অনেক আগে কিন্তু কোম্পানি থেকে কোন মাল দিচ্ছে না। এতে বাজারে সংকট সৃষ্টি হচ্ছ। ডিপু থেকে তেল সরবরাহ করছে না। রমজানের মধ্যে প্রোডাক্টশন চালু হবে কিনা সে বিষয়ে তার জানা নেই।
বেশিরভাগ দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের ৫ লিটার নেই। রয়েছে শুধু ২ থেকে ৩ লিটারের বোতল। কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে না বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। তারিকুল নামের ক্রেতা বলেন, এসব তেল মজুত করে রাখা হয়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য এই কাজ করেছে অবৈধ সিন্ডিকেট।
আরেক ক্রেতা মো. ইদ্রিছ বলেন, সব মুদি দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করা হয়, এখন অধিকাংশ দোকানেই সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোন দোকানে পাওয়া গেলেও তা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ সুযোগে খোলা তেলের দাম বেড়ে গেছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সাধারণ সম্পাদক সজিব ইসলাম জানান, বাজারে বর্তমানে তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। রোজায় দ্রবের দাম সহনীয় রাখতে উপজেলা প্রশাসনের সমন্নয়ে বাজার মনিটরিং করা হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ফরিদপুরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, সয়াবিন তেল কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফার আশায় তাদের প্রোডাক্টশন বন্ধ করে রেখেছে বিধায় বাজারে তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে সয়াবিন তেলের সঙ্গে কম চাহিদার পণ্য নিতে বাধ্য করছেন।
মধুখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এরফানুর রহমান বলেন, রোজার মাস ধরে বাজারে অভিযান চলবে। যারা বাজারে দ্রব্য মজুদ রাখবে, দাম বেশি রাখবে, এবং ওজনে কম ও ভেজাল দেবে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, মোহনগঞ্জে কিছু অসাধু ডিলার ব্যবসায়ী রমজান উপলক্ষে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে সয়াবিন তেল সংকট তৈরি করেছে। সয়াবিন তেল ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যতেও মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে।
বৃহস্পতিবার মোহনগঞ্জ উপজেলা মাল্টিপারপাস হলরুমে, ইউএনও জুয়েল আহমেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সহকারী কমিশনার ভূমি এম এ কাদের, মোহনগঞ্জ থানার ওসি আমিনুল ইসলাম, ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দিক, মোহনগঞ্জ সাংবাদিক এমএস দোহা, মাসুম আহম্মেদ, হাফিজুর রহমান চয়ন, সাইফুল আরিফ জুয়েল, জাকারিয়া তুষার, মাদ্রাসা শিক্ষক নূরুল হুদা প্রমুখ।
বক্তারা রমজান উপলক্ষে মোহনগঞ্জে মদের দোকান এক মাস বন্ধ রাখার দাবি জানান। সেই সঙ্গে বিদু্যৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, বাজার মনিটরিং, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।