শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

এখনো শতবর্ষের ঐতিহ্য নিয়ে সুনাম ছড়াচ্ছে কুমিলস্নার রসমালাই

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও নকল রসমালাইয়ের ছড়াছড়ি
আবদুল জলিল ভূইয়া, কুমিলস্না
  ১৭ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০
কুমিলস্নার রসমালাই

কুমিলস্নায় বেড়াতে এসে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন লোক কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। বিয়ে, ঈদ, পূজা, জন্মদিন কিংবা রাষ্ট্রীয় বড় অনুষ্ঠান কুমিলস্নার রসমালাই ছাড়া আপ্যায়ন যেন জমেই না। কিন্তু যে স্বাদ, গুণ, সুনাম আর ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের জগৎজোড়া খ্যাতি; কিন্তু সেই রসমালাই ভেজাল আর নকলের ভিড়ে জৌলুস হারাতে বসেছে। প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। আসল রসমালাই মানেই কুমিলস্নার মাতৃভান্ডার। কিন্তু সেই মাতৃভান্ডারের নামে এখন কুমিলস্নাসহ বিভিন্ন জেলায় চালু রয়েছে শত শত দোকান। অসাধু ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম নকল করে বা ওই নামের সামনে-পেছনে অন্য শব্দ ব্যবহার করে ভেজাল বা নকল রসমালাই তৈরি করে এবং তা বিক্রি করে ক্রেতাদের প্রতারিত করার পাশাপাশি রসমালাইয়ের সুনাম ও ঐতিহ্য বিলীন করে দিচ্ছে। এতে নকল ও ভেজাল রসমালাইয়ের ভিড়ে এখন আসল মাতৃভান্ডারের রসমালাই চেনাই দুরুহ হয়ে পড়েছে। তবে আর যা-ই হোক মিষ্টির রাজা কুমিলস্নার রসমালাইকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক জিআই স্বীকৃতির তালিকায় আছে কুমিলস্নার রসমালাই।

আসল রসমালাইয়ের ইতিহাস : উইকিপিডিয়ার প্রকাশিত তথ্য মতে রসমালাই দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালের একটি জনপ্রিয় মিষ্টি খাদ্য। ছোট ছোট আকারের রসগোলস্নাকে চিনির সিরায় ভিজিয়ে তার ওপর জ্বাল-দেওয়া ঘন মিষ্টি দুধ ঢেলে রসমালাই বানানো হয়। বাংলাই রসমালাইয়ের উৎপত্তি স্থল। বাংলাদেশের কুমিলস্না এবং ভারতের কলকাতায় রসমালাই খুবই বিখ্যাত। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিলস্নার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো 'ভোগ' বা রসগোলস্না ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগ রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৩০ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামে দুই ভাই কুমিলস্নায় এসে শহরের মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভান্ডার নামে একটি দোকান দিয়ে ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি শুরু করেন। সুস্বাদু হওয়ায় এর বিক্রি বাড়তে থাকে। এক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। খনিন্দ্র সেনের এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে শংকর সেন। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মারা গেছেন। ছোট মেয়ের নাম স্মৃতি সেন। মনিন্দ্র সেন বিয়ে করেননি। ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃভান্ডার পরিচালনা করা শুরু করেন। মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, মাতৃভান্ডার নামে এ মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠার পর তাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তাদের অভিজ্ঞ ১০ কারিগর এই রসমালাই তৈরি করছেন। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন। দিনে দিনে এই রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেলা পরিক্রমা অনুষ্ঠানে কুমিলস্নার অন্যান্য ঐতিহ্য দেখানোর পাশাপাশি মাতৃভান্ডারের রসমালাইও দেখানো হয়। এরপর সারাদেশে রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। দেশের বড় বড় সভা ও অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়ন করা হয় এই রসমালাই দিয়ে। আর কুমিলস্নায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন ঘটনা বিরল।

রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া : রসমালাই বানানোর কৌশল এতটা সহজ নয়। কারিগররা জানান, 'প্রথমে বিভিন্ন গোয়ালার কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। অন্তত দুই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে ছানায় রূপ নেয়। এরপর ছানা কেটে ছোট ছোট দানাদার মিষ্টির মতো বানানো হয়। পরে রসের মধ্য দিয়ে সেটি রসমালাইয়ে পরিণত করা হয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত গীতা পাসি কুমিলস্নায় এসে মাতৃভান্ডার থেকে রসমালাই নিতে এসে এর বেশ প্রশংসা করেন। বর্তমানে প্রতি কেজি রসমালাইয়ের দাম ২৮০ টাকা। কুমিলস্নার মাতৃভান্ডারে প্রতিদিন প্রায় ৫ মণ রসমালাই তৈরি করা হয় বলে কারিগর সূত্রে জানা গেছে। আসল মাতৃভান্ডার ছাড়া কুমিলস্নার রসমালাই তৈরি হয় নগরীর ভগবতি পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, পোড়াবাড়ি, জলযোগসহ কয়েকটি মিষ্টির দোকানে।

আসল ও ভেজাল রসমালাই যেভাবে তৈরি হয় :নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন কারিগররা জানান, ভারতীয় এক কেজি 'শক্তি', 'মধু' পাউডার দুধ দিয়ে ১০ কেজি দুধ বানানো যায়। এ কারণে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী গরুর আসল দুধ ব্যবহারই করে না। দুধ ব্যবহার করলেও তা অর্ধেক থাকে পানি। তাছাড়া যে ছানা দিয়ে রসমালাইয়ের গুটি বানানো হয় তাতে এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দার স্থলে এক পোয়া ময়দা মেশানো হয়। তাতে তিন কেজির জায়গায় চার কেজি গুটি হয়। কিন্তু এতে রসমালাইয়ের সত্যিকারের স্বাদ থাকে না।

অন্যদিকে কুমিলস্নার ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের দোকানগুলোর কারিগরদের সূত্রে জানা গেছে, ভেজাল রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া। তারা জানান, এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ১৪ কেজি রসমালাই বানানো যায়। কিন্তু ভেজালকারীরা এক মণ দুধ দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি রসমালাই বানায়। আসল দুধের সঙ্গে এক কেজি পরিমাণ পাউডার দুধ আর আধা কেজি ময়দা মেশানো হয়। এর ফলে কিছুক্ষণ জ্বাল দিলেই দুধ ঘন হয়ে যায়। ১৪ কেজির স্থলে পাওয়া যায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি রসমালাই।

চারদিকে নকল রসমালাইয়ের ছড়াছড়ি : যুগ যুগ ধরে রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত কুমিলস্না। ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্ন এখন নকলের ভিড়ে আসল পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। প্রায় শত বছর আগে 'মাতৃভান্ডার মিষ্টান্ন' প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বর্তমানে শহরের আনাচে কানাচে ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে অগণিত রসমালাই বিক্রয়কারী দোকান। যাদের প্রত্যেকেরই দাবি তারাই একমাত্র ও আসল মাতৃভান্ডার। তবে মূল প্রতিষ্ঠানের দাবি মূল বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়া কোথাও তাদের আর কোনো শাখা বা বিক্রয়কেন্দ্র নেই। তাই এসব দোকান থেকে রসমালাই কিনে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। আসল রসমালাইয়ের স্বাদ পেতে চাইলে পেতে হবে আসল জিনিস। কারণ কুমিলস্না শহরকে ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল যে রসমালাই, তার স্বাদ অনেকেই পান না। কুমিলস্নার বিখ্যাত এই রসমালাই পেতে আপনাকে যেতে হবে কুমিলস্না শহরের মনোহরপুরের কুমিলস্না মাতৃভান্ডার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এখান থেকেই অমৃত এই রসমালাই যাত্রা শুরু করেছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ী মৃনাল নাথ ও হরনাথ পোদ্দার জানান, সেনানিবাস থেকে পদুয়ার বাজার পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রসমালাই বিক্রয়কারী দোকান। প্রায় সবগুলোতেই বিশাল বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা 'কুমিলস্নার মাতৃভান্ডারের আদি ও একমাত্র রসমালাই'। আবার অনেকগুলোতে মাতৃভান্ডার নামের আগে 'আদি', 'নিউ', 'নিপা', 'প্রয়োজনীয়' ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিলেও আকারে এতই ছোট যে এগুলো খুব সহজেই সাধারণ ক্রেতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এসব দোকান মালিকদের সবারই দাবি তাদের দোকানে আসল রসমালাই পাওয়া যায়। সেনানিবাস থেকে পদুয়ার বাজার পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রসমালাই বিক্রয়কারী দোকান। প্রায় সবগুলোতেই বিশাল বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা 'কুমিলস্নার মাতৃভান্ডারের আদি ও একমাত্র রসমালাই'। আবার অনেকগুলোতে মাতৃভান্ডার নামের আগে 'আদি', 'নিউ', 'নিপা', 'প্রয়োজনীয়' ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিলেও আকারে এতই ছোট যে এগুলো খুব সহজেই সাধারণ ক্রেতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এসব দোকান মালিকদের সবারই দাবি তাদের দোকানে আসল রসমালাই পাওয়া যায়। এ রকম অর্ধশতাধিক মিষ্টির দোকান রয়েছে মহাসড়কের পাশে। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে কোনোটিতে লেখা আছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত', কোনোটিতে লেখা 'আমাদের একমাত্র শাখা এটি', কোনোটিতে আছে 'আমাদের দ্বিতীয় শাখা'। মাতৃভান্ডারের নাম ব্যবহার করে ভেজাল রসমালাই তৈরি করে এবং বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। সেই সঙ্গে তারা নষ্ট করছে কুমিলস্নার আসল ও অতুলনীয় স্বাদের রসমালাইয়ের সুনাম। প্রকৃত পক্ষে আদি ও আসল রসমালাই তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান কুমিলস্না মাতৃভান্ডারের কোনো শাখা নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এসব দোকানে খুবই নিম্নমানের রসমালাই বিক্রি করা হয়। এসব দোকানে যে স্থানে কারিগররা রসমালাই তৈরি করে সেখানকার পরিবেশ খুবই নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। এসব দোকান থেকে রসমালাই কিনে ক্রেতারা সহজেই প্রতারিত হচ্ছেন। এতে করে নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কুমিলস্নার রসমালাইয়ের সুনাম ও গৌরব।

আন্তর্জাতিক জিআই স্বীকৃতি : বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ১৯৯৪ সালের এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সদস্য দেশগুলো। যার মধ্য দিয়ে প্রতিটি দেশ তার ভূখন্ডে উৎপাদিত পণ্য, বস্তু ও জ্ঞানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) আইনের মাধ্যমে নিবন্ধনের অধিকারপ্রাপ্ত হয়। তবে দীর্ঘদিন নজর না দেওয়ার পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের অধীনে ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। কুমিলস্নার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলমের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সুপরিচিত দুটি পণ্য কুমিলস্নার রসমালাই ও খাদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাই নকল যা-ই হোক না কেন আসল রসমালাইকে নিয়ে কুমিলস্না গর্ববোধ করতেই পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<115529 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1