সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২
ঢাকা শিশু হাসপাতাল

নির্ধারিত শয্যার ৪ গুণ ডেঙ্গু রোগী

চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩৫৫ শিশু এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সাত শিশু মারা গেছে
জাহিদ হাসান
  ২৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ২৬ আগস্ট ২০২১, ০৯:৩৬
নির্ধারিত শয্যার ৪ গুণ ডেঙ্গু রোগী
নির্ধারিত শয্যার ৪ গুণ ডেঙ্গু রোগী

করোনা মহামারির মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই দশা সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু কর্নারে ১৬ জন রোগীর জন্য নির্ধারিত শয্যা থাকলেও মঙ্গলবার সেখানে চিকিৎসাধীন শিশু রোগী ছিল ৬৭ জন। রোগীর চাপ অনুপাতে ডেঙ্গু কর্নারে পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের অন্যান্য ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। সরেজমিন শিশু হাসপাতাল পরিদর্শন করে এই চিত্র দেখা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩৫৫ শিশু এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই মাসে ১০৪ জন, আগস্টের ২৪ দিনে ২৮৬ জন এবং গত ১০ দিনে ভর্তি হয়েছে ১১০ জন শিশু। এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সাত শিশু মারা গেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগী অনেক বেশি বলে যায়যায়দিনকে জানান শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ। তিনি বলেন, শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় হাসপাতালে একটি বিশেষায়িত কর্নার চালু করা হয়েছে। সেখানে ১৬টা শয্যার সবই রোগীতে পূর্ণ। এর বাইরে, অন্যান্য ওয়ার্ডেও রোগী ভর্তি রয়েছে। আজকেও (মঙ্গলবার) আইসিসিইউতে ৭ জন রোগী রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন ঢাকা শিশু হাসপাতালের ২নং ওয়ার্ডে গিয়ে সেখানে বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারের ইউনিট-এম'র ৮ শয্যার সবই রোগীতে পরিপূর্ণ দেখা গেছে। এই ওয়ার্ডের ৩৮ নম্বর বেডে গত ১৪ আগস্ট থেকে ৯ মাস বয়সি শিশু সাইদ ভর্তি রয়েছে। পাশেই ৪০ শয্যার বেডে ১৭ আগস্ট থেকে ভর্তি আছে সাইদের আরেক ভাই সাত বছর বয়সি শিশু আসয়াদ। জানতে চাইলে এই দুই শিশু রোগীর বাবা মুফতি মাহবুব যায়যায়দিনকে বলেন, তিনি রাজধানীর মহাখালী দক্ষিণ পাড়ায় একটি মসজিদের ইমাম। হঠাৎ ছোট ছেলের জ্বর দেখা দেওয়ায় ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর এক সপ্তাহ পিআইসিউইতে (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ ইউনিট) রাখতে হয়েছিল। তখন দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়। এরই মধ্যে আরেক ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে অর্থ সংকটে পড়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এখানেও হাসপাতালের শয্যা ভাড়া, দুই ছেলের ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ প্রতি?দিন গড়ে ৭ থে?কে ১২ হাজার টাকা খরচ হ?চ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একই ওয়ার্ডের ৩৬ নম্বর বে?ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০ বছরের শিশু উ?ম্মে সাদিয়া। শিশুটির মা নাজমা বেগম কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে যায়যায়দিনকে বলেন, কয়েকদিন ধরে মেয়ের জ্বর, ব?মি, পেট ব্যথার সঙ্গে শরী?রেরর্ যাশ দেখা দিলে চার ?দিন আ?গে এখানে নিয়ে আসি। চিকিৎসকরা বলছেন, বু?কে পা?নি জমেছে, শরী?রের ভেত?রে রক্তক্ষরণ হ?চ্ছে। ভর্তির পর থে?কে সুস্থতার জন্য তিন বেলা মো?রো?পেন ইন?জেকশন ?দি?চ্ছেন। যার প্রতি ডো?জের দাম ৯০০ টাকা। সঙ্গে অন?্যান?্য টেস্টসহ দৈনিক ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হচ্ছে। নাজমা বেগম আরও বলেন, তার স্বামী সবুজবাগের মাদারটেক এলাকায় ভ?্যা?নে ফেরি করে কসমেটিকস বি?ক্রি কর?তেন, ক?রোনায় ব্যবসা বন্ধ আ?ছে। দুই মে?য়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে এমনিতেই অভাবের সংসার, তার ওপর বেশ কিছু দিন ধরে ওর (শিশুর) নানি ঢা?কা মেডিকেল ভর্তি রয়েছেন। মায়ের চিকিৎসায় টাকা-পয়সা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে ছোট্ট মেয়েটাও ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে। সব মিলে তিনি অন্ধকার দেখছেন। 'ডেঙ্গু সন্দেহে তিন দিন ধরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের ৭নং ইমা?র্জেন্সি, অবজারভেশন অ্যান্ড রেফা?রেল ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে চার বছর বয়সি শিশু ফাহ?মিদা। তার বাবা ফারুক আলম ব?লেন, 'শুনেছি ডেঙ্গু হলে জ্বর, বমি ও চোখে ব্যথাসহ চোখ দিয়ে রক্তও আসতে পারে। গত সপ্তাহে মেয়ের এসব লক্ষণ দেখা দিলে শরীয়তপুরে স্থানীয় একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি করি। চিকিৎসকরা ডেঙ্গু ও টাইফ?য়েড স?ন্দেহ করলে এখানে আসার পর কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা কর?তে দি?য়ে?ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফলাফল পাইনি। ডেঙ্গু বা করোনা ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে রেফার করা হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।' ডেঙ্গু ওয়ার্ডের দায়িত্বরত কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স যায়যায়দিনকে ব?লেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখে দেওয়ার পর শিশুদের চিকিৎসায় এই ওয়া?র্ডের ১৬ বেডের একটি বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নার খোলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই ওয়ার্ডের সব শয্যাই ডেঙ্গু রোগীতে পরিপূর্ণ থাকছে। শয্যা সংকটে অন্যান?্য (মেডিসিন) ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী ভ?র্তি করা হচ্ছে। প্রতি?দিন রোগীর চাপ বাড়?ছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এবার কেন বেশি জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। এডিস মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ ছড়ায়। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন রয়েছে, যার মাধ্যমে একজন মানুষ সারা জীবনে চারবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। তবে একবার এক স্ট্রেইনের পর পুনরায় আরেক স্ট্রেইনে আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এ বছর ২০১৯ সালের স্ট্রেইন-৩ আবার আসছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে ২০১৯ সালের পর জন্ম নেওয়া শিশুদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বে ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হয় ১০ বছরের নিচের শিশুরা। এর প্রথম কারণ এডিস মশা ৫ ফিটের ওপরে উড়তে পারে না বলে সহজে শিশুদের কামড়াতে পারে। আরেকটি কারণ বেশিরভাগ শিশু বাড়িতে হাফসিস্নপ পোশাক পরিধান করায় সহজেই মশার কামড়ের শিকার হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা যায়যায়দিনকে আরও বলছেন, এ বছর করোনার কারণে শিশুদের জ্বর দেখা দিলেও অনেক অভিভাবক সংক্রমণ ভয়ে সহজে হাসপাতালে আসছে না। কিন্তু যখন জ্বর কমে যায়, তখন ডেঙ্গুর জটিলতা প্রকাশ পেতে থাকে। এ সময় শিশুর শরীরে পানি জমে শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে। রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরের ভিতর রক্তক্ষরণ হতে পারে, অনেকের শরীরেরর্ যাশ উঠে দ্রম্নত খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু যখন হাসপাতালে নিয়ে আসছে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক শফি আহমেদ আরও বলেন, এ বছর থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে এডিস মশা বাড়বে। তাই ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় শিশুরা দিনে বা রাতে যখনই ঘুমায় তখনই মশারি দিতে হবে। এডিস মশার ডিম থেকে লার্ভা হয়, তা থেকে মশার জন্ম হয়, এজন্য লার্ভা যেন জন্মাতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। শিশুর জ্বরভাব, পেটে ব্যথা, পেটে পানি আসা, বমি হওয়া, চোখে ব্যথা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলে দ্রম্নত হাসপাতালে নিতে হবে। ডেঙ্গু শনাক্তে এনএস-১ পরীক্ষা করাতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে