বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পথে ঘরমুখো মানুষের চাপ

ম যাযাদি রিপোর্ট
  ০৬ জুলাই ২০২২, ০০:০০
স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। ছবিটি মঙ্গলবার রাজধানীর কমলাপুর রেলস্ট্রেশন থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

ঈদের ছুটি শুরু না হলেও সড়ক-নৌ ও রেলপথে ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়ছে। মঙ্গলবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ বিভিন্ন গন্তব্যে ঢাকা ছেড়েছে। এদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মজীবীরাও রয়েছেন। ঢাকায় বসবাসরত বিপুল সংখ্যক রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিও আগেভাগেই গ্রামে যাচ্ছেন।

ঘরমুখো মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কিছুটা বেশি সময় কাটানোর পাশাপাশি কোরবানির জন্য পশু কেনার জন্য বরাবরের মতো এবারও তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র দেড় বছর বাকি থাকায় রাজনীতিকরাও এ দলে ভিড়েছেন। এছাড়া সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ দুর্ভোগে থাকা স্বজনের পাশে দাঁড়াতে আগেভাগে এলাকায় ফিরছেন।

মঙ্গলবার ভোরে মালিবাগের সোহাগ কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, যশোর, খুলনা, বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ প্রতিটি রুটের বাসের আসন পূর্ণ। দুপুর পর্যন্ত এসি, নন-এসি কোনো বাসের একটি টিকিটও অবিক্রীত নেই। নৈশকালীন বাসের সামান্য দু'একটি টিকিট অবিক্রীত থাকলেও বেশিরভাগেরই টেলিফোনে বুকিং দেওয়া আছে।

মালিবাগ কাউন্টারের সেলসম্যান সাইফুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, যশোর, খুলনা, বেনাপোল, সাতক্ষীরা ও নড়াইল রুটে চলাচলকারী এসি, নন-এসি বাসের ৭৫ শতাংশই এখন পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে চলাচল করছে। বাকি ২৫ শতাংশ গাড়ি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট হয়ে চলছে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর যেতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা সময় লাগছে। ফেরিঘাটে যানজট না থাকায় এ পথেও এখন দুর্ভোগ কমেছে। ঢাকা থেকে বেনাপোল যেতে আগে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা লাগলেও এখন ৭ থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টায় অনায়াসে পৌঁছানো যাচ্ছে।

সেলসম্যান সাইফুলের দাবি, সাধারণ সময়ের চেয়ে ঘরমুখো মানুষের চাপ অনেক বেড়েছে। দিনে তীব্র গরম থাকায় নন-এসি বাসের যাত্রীরা দিনের চেয়ে রাতেই বেশি যাতায়াত করছেন। বৃহস্পতিবার নৈশ কোচের প্রতিটি বাসের টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তবে যাত্রীর চাপ আরও বাড়লে অতিরিক্ত একাধিক বাস সংযোজন করা হবে।

হানিফ পরিবহণের গাড়িচালক মোজাম্মেল হোসেন জানান, ঘরমুখো মানুষের ঢল নামায় সড়ক-মহাসড়কে গণপরিবহণের চাপ বেড়েছে। ঢাকা-খুলনা রুটের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে থেমে থেমে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরের পর এসব পয়েন্টে যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান এই গাড়িচালক।

তার দাবি, যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে কোরবানির পশুবাহী ট্রাকের চাপ বাড়ায় বুধবার থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ রুটে যানজট সৃষ্টি হবে। আগে এসব এলাকা থেকে ঈদের বেশ আগেই ধাপে ধাপে কোরবানির পশু ঢাকায় আসলে পদ্মা সেতু চালুর পর সে চিত্র পাল্টে গেছে। পশু ব্যবসায়ী ও গৃহস্থরা এখন হাট শুরুর দিন কিংবা একদিন আগে গরু-ছাগল ঢাকায় আনার টার্গেট নিয়ে বসে আছেন। ঢাকার অস্থায়ী পশুর হাটগুলোতে যেহেতু বুধবার থেকে আনুষ্ঠানিক বেচাকেনা শুরু হবে, ফলে এদিন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের চাপ তীব্র হবে।

এদিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আন্তঃজেলার অধিকাংশ মহাসড়কে বড় ধরনের কোনো যানজট না থাকলেও ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের বাস প্রবেশ ও বের হতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। গণপরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় সিটি করপোরেশনের কাজ চলায় সেখানে ছোটবড় যানজট লেগেই থাকছে। পদ্মা সেতুর কারণে সায়েদাবাদ ও আশপাশ এলাকায় গাড়ির চলাচল বাড়ায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে উঠেছে। যা আজ বুধবার থেকে আরও বাড়তে পারে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের অন্যতম পথ উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুর সড়কে বড় বড় গর্ত থাকায় সেখানে সোমবার থেকেই থেমে থেমে যানজট দেখা গেছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির কার্যনির্বাহী সভাপতি আবুল কালাম বলেন, সড়কের যে অবস্থা তাতে ঈদযাত্রায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হবে। এখনই যানজট শুরু হয়েছে। টঙ্গী থেকে কলেজগেট পর্যন্ত রাস্তায় বড় বড় গর্ত রয়েছে। এসব দ্রম্নত মেরামত করা না হলে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

সায়েদাবাদ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সায়েদাবাদ এলাকায় গাড়ির চাপ বেড়েছে। যাত্রীবাহী ছাড়াও পণ্যবাহী গাড়ি আশপাশ এলাকায় পার্কিং করছে। এতেও সড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া সায়েদাবাদ টার্মিনালের কাছাকাছি সড়ক সংস্কারের কাজ চলায় যানজট তৈরি হচ্ছে।

এদিকে রেলপথে অগ্রিম টিকিট কেনার ভিড় কমলেও যাত্রীর চাপ বেড়েছে। তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে সিডিউল বিপর্যয়ও। সরেজমিন মঙ্গলবার সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখান থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের প্রতিটি বগিই যাত্রীতে কানায় কানায় পূর্ণ। কোনো বগিতেই একটি আসনও ফাঁকা নেই। বরং আসনবিহীন যাত্রীর আধিক্য দেখা গেছে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চারটি ট্রেন ২০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। ট্রেন নির্ধারিত সময় না ছাড়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।

নীলফামারীর চিলাহাটিগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৬টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও এক ঘণ্টা দেরিতে কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে গেছে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ বাজারগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি সাড়ে ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ৭টা ৫৫ মিনিটে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

সুন্দরবন এক্সপ্রেসে ট্রেন ৮টা ১৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সোয়া ৯টা পর্যন্ত ট্রেনটি কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে যায়নি। ধুমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ৬টায় কমলাপুর রেলস্টেশন ছাড়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি কমলাপুর ছাড়ে দেড় ঘণ্টা দেরিতে।

কমলাপুর রেলস্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার দেরিতে ট্রেন ছাড়ার কথা স্বীকার করলেও এটাকে শিডিউল বিপর্যয় বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, 'আমাদের অপারেশনাল বিলম্ব ছিল। আশা করি আগামী দিনগুলোতে এটা ঠিক হয়ে যাবে।' মঙ্গলবার মোট ৩৭ জোড়া ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়েছে।

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রির শেষ দিন মঙ্গলবার অন্যান্য দিনের তুলনায় টিকিট প্রত্যাশীদের ভিড় ছিল অনেক কম। শেষ দিন হিসেবে এদিন ৯ জুলাইয়ের টিকিট বিক্রি হয়েছে।

এদিকে গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এলেও ঈদকে সামনে রেখে তা কিছুটা বেড়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক যাত্রীকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে। এসব যাত্রীদের একটি বড় অংশ অসুস্থ কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন।

যাত্রী কমে যাওয়ায় সদরঘাট টার্মিনালে লঞ্চ কর্মচারীদের ডাকাডাকি বেড়েছে। টার্মিনালে যাত্রীরা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তারা কেউ কেউ যাত্রীর মালামাল নিয়ে টানাটানি করছেন। কেউবা লঞ্চের নানা সুযোগ-সুবিধার বয়ান দিচ্ছেন। তবে বরিশাল রুটের যাত্রী ব্যাপক হারে কমলে ভোলা রুটে যাত্রীর সংখ্যা আগের মতোই রয়েছে।

লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব ও পারাবত লঞ্চের মালিক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, তার ছয়টি লঞ্চের মধ্যে বর্তমানে তিনটি চলাচল করছে। যাত্রী কমে যাওয়ায় এগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। লঞ্চ মালিক সমিতির এ নেতার অভিযোগ, বিগত ৩৫ বছরে যত সরকার এসেছে সবাই নদীপথকে অবহেলিত করে রেখেছে। গুলিস্তান থেকে সদরঘাটে আসতে মানুষকে যানজটের সঙ্গে একরকম যুদ্ধ করতে হয়। ড্রেজিংয়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করা হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। ঈদের সময় যাত্রী কিছুটা বাড়লেও ঈদ পরবর্তী সময়ে লঞ্চ মালিকদের সংকটে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বরিশালগামী যাত্রী ইমারত হোসেন জানান, ঈদযাত্রায় সড়ক পথে যানজট ও দুর্ঘটনা বেশি ঘটায় তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে লঞ্চেই বাড়িতে যাচ্ছেন। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় যেহেতু ৪ সাড়ে ৪ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া যাবে, তাই স্বাভাবিক সময় তিনিও সড়ক পথেই যাতায়াত করবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে