নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন দুই উপজেলা হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসন। একটি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হয়। এখানকার আওয়ামী রাজনীতির এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ। অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগের নেপথ্য মদতে রয়েছেন মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খানসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা। অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে ইতোমধ্যে সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ওই নির্বাচনী এলাকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে পর্যন্ত দাওয়াত দেওয়া হয়নি দলীয় এই সংসদ সদস্যকে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ। একই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ডক্টর শাম্মী আহমেদ ও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করীম। আফজালুল করীম বলেন, আমার ত্যাগের বিষয়টি মূল্যায়ন করে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি নৌকা প্রতীক দেন, তাহলে ইনশাআলস্নাহ আমি বিজয় লাভ করতে পারব। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ডক্টর শাম্মী আহমেদের জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। শৈশব থেকেই তিনি দেখেছেন তার বাবার রাজনীতি। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি তার গভীর অনুরাগ। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদের মেয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন মহিউদ্দিন আহমেদ। আর তার মেয়ে ডক্টর শাম্মী আহমেদ কাজ করছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তিনি (শাম্মী) কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। ডক্টর শাম্মী আহমেদ বলেন, এলাকার দলীয় নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই আমাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে আসছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি প্রার্থী হব। এদিকে বরিশাল-৪ আসনটি স্থানীয় রাজনীতিতে সংঘাতপূর্ণ এলাকা হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের অনুসারী ও তার দলীয় প্রতিপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এলাকাটিতে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। দুই পক্ষের রাজনৈতিক সংঘাতে আসনটিতে গত ৯ বছরে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে তিনি তার পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। যারা নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেন। এ নিয়েই মূলত সংসদ সদস্যের সঙ্গে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা বলছেন, জেলা আওয়ামী লীগের ইন্ধনে একটি পক্ষ বরিশাল-৪ আসনের জনপ্রিয় সংসদ সদস্যেকে ঠেকানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে পাস করে সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। তবে ওই নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির দখলেই ছিল আসনটি। ২০১৪ সালে ওই আসনে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে সংসদীয় এই আসনটিতে নৌকার অবস্থা এখন নাজুক। স্বেচ্ছাসেবক লীগের একক আধিপত্যের কারণে স্থানীয় প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন করছেন। যদিও এজন্য মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের অযোগ্য দাবি করছেন দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা। সূত্র মতে, সম্প্রতি মেহেন্দিগঞ্জে ভোটযুদ্ধে নৌকাকে পরাজিত করে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়; দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগে একটি ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের সঙ্গে স্থানীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের চলমান বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে এর খেসারত দিতে হতে পারে। আসনটি পুনরায় হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা। মেহেন্দিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন খান বলেন, সম্প্রতি এমপি পঙ্কজ নাথের সঙ্গে এক পুলিশ অফিসারের মোবাইল ফোনের কথোপকথন অডিও ফাঁস হয়। ওই কথোপকথনে একপ্রান্ত থেকে রামদা দিয়ে আমাকে (কামাল) কোপানোর নির্দেশদাতা হচ্ছেন পঙ্কজ নাথ। তিনি (পঙ্কজ নাথ) দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে এসব বলতে পারেন না। মেহেন্দিগঞ্জকে অশান্ত করতে এমপি পঙ্কজ দীর্ঘদিন থেকে ষড়যন্ত্র করে আসছেন। তবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন না দেওয়াসহ মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও এডিটিং করা হয়েছে দাবি করে সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ বলেন, আমি জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় নেতার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার বদনাম করতে ওইসব নেতারা দীর্ঘদিন থেকে ষড়যন্ত্র করে আসছেন। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ আরও বলেন, 'আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি করি। কিন্তু দলের তৃণমূল পর্যায়ে কতিপয় প্রভাবশালী নেতার লোক হয়ে রাজনীতি না করার কারণে আমার মতো অনেক পঙ্কজ নাথের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে দলের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।' এছাড়া এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। তিনি এলাকায় নিয়মিত যোগাযোগও রক্ষা করে চলছেন। তবে এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিতেও রয়েছে কোন্দল। ফলে এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাউদ্দিন ফরহাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বরিশাল-৪ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়নের চিঠি পেয়েছিলেন বিএনপির নির্বাহী সদস্য ও সাবেক এমপি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান। শেষপর্যন্ত দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও জোটের কারণে আসনটি নাগরিক ঐক্যকে ছেড়ে দেওয়ায় সেখানে প্রার্থী হয়েছিলেন নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন চলাকালীন নাগরিক ঐক্যর ওই প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী এলাকার কোথাও পোস্টার লাগানোর লোকপর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়নি। একাদশ নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে ২ লাখ ৪১ হাজার ৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পঙ্কজ নাথ। তার নিকটতম বিএনপি মনোনীত নাগরিক ঐক্যর প্রার্থী জে এম নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর পেয়েছিলেন ৯ হাজার ২৮২ ভোট। নির্বাচনের পর থেকে অদ্যাবধি আর বরিশাল-৪ আসনের কোথাও দেখা মেলেনি নুরুর রহমান জাহাঙ্গীরের। ভোটের পর তিনি এলাকার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক পেতে কেন্দ্রে লবিং করছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি নুর রহমান জাহাঙ্গীর, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাজীব আহসান এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী হেলাল উদ্দিন। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক সংসদ সদস্য ও বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ বলেন, 'বিগত দিনে আন্দোলন সংগ্রামে আমি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি। দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।' আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ওই আসনে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী হবেন মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ নুরুল করীম। এ আসনে বড় দুই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে সাধারণ জনগণ চরমোনাই পীরের মনোনীত প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করবেন বলে আশা প্রকাশ করছে দলের নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি জাতীয় পার্টি (এরশাদ) থেকে মনোনয়ন পেতে লবিং করেছেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এছহাক ভূঁইয়া ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহকারী সম্পাদক হারুন-অর রশিদ। উলেস্নখ্য, ৯৪৯ দশমিক ২৯ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল-৪ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২৪ হাজার ১২৮ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪১৭ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭১১ জন। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৭৪টি। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলমান থাকায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।
আগামীকাল : বরিশাল-৫ আসনের বিস্তারিত