মিরপুরে টেস্টের প্রথম দিনেই যেন ম্যাচ দ্রম্নত শেষ হয়ে যাওয়ার আভাস। স্পিনারদের ঘূর্ণিতে স্বাগতিক বাংলাদেশ দল অলআউট হয়ে যাওয়ার পর সফরকারী নিউজিল্যান্ডও যেন আছে গুটিয়ে যাওয়ার পথে। মিরপুর শেরে বাংলায় বুধবার টেস্টের প্রথম দিনে লাটিমের মতো বল ঘুরছে। আর এই ঘূর্ণি-ফাঁদে পড়ে ১৭২ রানেই গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। জবাব দিতে নেমে স্বস্তিতে নেই নিউজিল্যান্ডও। ৫ উইকেটে ৫৫ রান নিয়ে প্রথম দিনের খেলা শেষ করেছে সফরকারীরা।
আলোক স্বল্পতায় আধ ঘণ্টার মতো বাকি থাকতেই প্রথম দিনের খেলা সমাপ্তি ঘোষণা করেন আম্পায়াররা। ব্যাটিংয়ে আছেন নিউজিল্যান্ডের গেস্নন ফিলিপস ৫ আর ড্যারেল মিচেল ১২ রানে। বাংলাদেশ এখনো ১১৭ রানে এগিয়ে। অর্থাৎ প্রথম দিনেই চালকের আসনে বসে পড়েছে স্বাগতিকরা। মিরপুরের পিচ প্রথম দিন থেকেই স্পিনারদের স্বর্গরাজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিনে দুই দলের যে ১৫ উইকেট পড়েছে, এর মধ্যে ১৩টিই নিয়েছেন স্পিনাররা।
মেঘলা আকাশ আর গুমোট আবহাওয়ায় ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে রাখা হলো দিনজুড়েই। তার পরও আলোক স্বল্পতায় খেলা শেষ বিকাল সোয়া চারটাতেই। আম্পায়ারের ইশারা পেয়ে হনহন করে ড্রেসিং রুমের পথে হাঁটা দিলেন নিউজিল্যান্ডের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান। যদি সম্ভব হতো, এই মাঠে হয়তো তারা আর ব্যাটিংয়েই ফিরতেন না! শুধু তারাই কেন, এই উইকেট তো বিভীষিকা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্যও।
মিরপুরের উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য মৃতু্যকূপ হয়ে ওঠা নতুন কিছু নয়। তবে এবার যেমন দেখা গেল, এরকম মাইনফিল্ড সম্ভবত আগে কখনো দেখা যায়নি। কোনো বল বিশাল টার্ন করছে তো কোনোটি যাচ্ছে একদম সোজা। কোনো ডেলিভারি হালকা টার্ন করছে, কোনোটি আবার লাফাচ্ছে অনেকটা। বোলারও হয়তো বুঝতে পারছিলেন না, বল কেমন হবে। ব্যাটসম্যানদের অবস্থা সহজেই বোধগম্য! প্রথম দিন প্রথম সেশন থেকেই যেন পঞ্চম দিন শেষ সেশনের রূপ দেখা গেল।
দিনভর স্পিনারদের বল ছোবল হানল বারবার। বল শার্প টার্ন করতে থাকল, বেকায়দায় বাউন্স দেখা দিল। একই জায়গায় পড়ে কোনো বল আবার সোজা গিয়ে করল বিভ্রান্ত। ব্যাটারদের জন্য ভীষণ কঠিন পরিস্থিতিতে রাজত্ব করলেন দুই দলের স্পিনাররা। আর সকাল থেকেই এদিন আকাশ ছিল কুয়াশায় ঢাকা, সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি একবারও। এমন পরিস্থিতিতে টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেওয়ার সাহস দেখান নাজমুল হোসেন শান্ত। অবশ্যই র?্যাঙ্ক টার্নারে রান তাড়া হতো আরও দুঃসাহস।
এমন উইকেটে যা হওয়ার কথা, হলোও তাই। ১৫ উইকেটের দিনে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে অলআউট ১৭২ রানে, নিউজিল্যান্ড দিন শেষ করেছে ৫ উইকেটে ৫৫ রানে। আলোর স্বল্পতায় ৮.২ ওভার আগে খেলা শেষ হয়েছে বলে তবু একটু রক্ষা। নইলে আরও গোটা দুই উইকেটের পতন হয়তো দেখা যেত। তার পরও যা হয়েছে, সেটিই রেকর্ড। মিরপুরে প্রথম দিনে এত উইকেটের পতন হয়নি আগে কখনো। ১৫ উইকেটের ১৩টিই নিয়েছেন স্পিনাররা, একটি নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের পেসার টিম সাউদি।
বাকি যে উইকেট, দিনের সবচেয়ে আলোচিত আউট সেটিই। মুহূর্তের খামখেয়ালিপনায় ব্যাখ্যাতীতভাবে 'অবস্ট্রাক্টিং দা ফিল্ড' আউট হন মুশফিকুর রহিম। তার পরও মুশফিকের ৩৫ রানের ইনিংসটিই দিনের সর্বোচ্চ। শাহাদাত হোসেন করতে পেরেছেন ৩১। এই দুজনের ৫৭ রানের জুটি দিনের একমাত্র অর্ধশত রানের বন্ধন। এছাড়া দুই দলের আর কোনো ব্যাটসম্যান ২০ ছাড়াতে পারেননি। স্কোর কার্ডের এই অবস্থাই পিচের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছে। তবে এসবও আসলে যথেষ্ট নয়। পিচ এমন যে, এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল প্রতি বলেই উইকেট পড়তে পারে।
দিনের প্রথম ১০ ওভারে যে উইকেট পড়েনি, এটিই এখন বলা যায় সবচেয়ে বড় বিস্ময়। নতুন বলে টিম সাউদি দারুণ সুইং আদায় করে নিয়েছেন। মাহমুদুল হাসান জয় বেশ কয়েকবার আউট হতে হতেও বেঁচে যান। তবে উইকেটের অবস্থা বুঝে ষষ্ঠ ও সপ্তম ওভারেই দুই প্রান্তে স্পিন আক্রমণে আনেন কিউই অধিনায়ক। তবে উইকেটের অবদান তো ছিলই, স্পিনারদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও। ১০ ওভার কাটিয়ে দেওয়ার পর মিচেল স্যান্টনারকে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় উইকেট বিলিয়ে আসেন জাকির হাসান। পরের ওভারেই জোরের ওপর রক্ষণাত্মক শট খেলার চেষ্টায় আউট হন জয়।
ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই নড়বড়ে দেখাল বাংলাদেশের ব্যাটিং। পেসাররা বল করলেন প্রথম পাঁচ ওভার। এরপর স্পিনাররা আক্রমণে আসতেই তুলতে থাকলেন একের পর এক উইকেট। প্রথম সেশনে ৮০ রানে পড়ল ৪ উইকেট, দ্বিতীয় সেশনে মুশফিকুর রহিমের 'অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ডের' আউটসহ ৬৯ রানে পড়ল আরও ৪ উইকেট। শেষ সেশনের শুরুতে গুটিয়ে গেল বাংলাদেশ দল।
তবে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৫ রান করেন মুশফিক, সবচেয়ে বড় ভুলও করেন তিনি। কাইল জেমিসনের বল ডিফেন্ড করার পর হাত দিয়ে আটকে দিয়ে অদ্ভুতভাবে 'অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ডের' আউটের শিকার হন তিনি। মুশফিক ছাড়া পরিস্থিতি বুঝে খেলছিলেন আরও একজন, সেই শাহাদাত হোসেন দিপু করলেন ৩২ রান। এছাড়া মেহেদী হাসান মিরাজ ২০ আর নাঈম হাসান করেন ১৩ রান। শুরুতে বারবার সুযোগ দেওয়া মাহমুদুল হাসান জয় করেছিলেন ১৪ রান। বাকি আর কেউ দুই অঙ্কের দেখা পাননি। বাংলাদেশের ব্যাটাদের কঠিন সময় দিয়ে মিচেল স্যান্টনার ৬৫ রানে ৩ ও গেস্নন ফিলিপস ৩১ রানে পান ৩ উইকেট।
বাংলাদেশকে ১৭২ রানে গুটিয়ে শেষ বিকেলে নেমে প্রথম পাঁচ ওভার পার করে দিলেও ধস নামে কিউই ইনিংসে। মিরাজের স্টাম্প বরাবর বল ছেড়ে বোল্ড হন ডেভন কনওয়ে। টম ল্যাথাম তাইজুল ইসলামের বলে ক্যাচ দেন কিপারের হাতে। হেনরি নিকোলস তাইজুলের বলে ছুঁড়ে দেন উইকেট। মিরাজের বলে কেইন উইলিয়ামসন শর্ট লেগে শিকার হন শাহাদাতের দারুণ ক্যাচের। কিপার ব্যাটসম্যান টম বস্ন্যান্ডেল এসেই ফেরেন এলবিডবিস্নউতে। আলো কমে যাওয়ায় এরপর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কিউইরা। প্রথম দিনের খেলা শেষের প্রায় ৮ ওভার আগে ৪টা ১৬ মিনিটে খেলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন আম্পায়াররা।
মিরপুরের উইকেটের আচরণ আভাস দিচ্ছে দ্বিতীয় দিনে আরও নাটকীয় পরিস্থিতির। বৈরী আবহাওয়া ছাড়া এই ম্যাচের আয়ু বেশি দূর এগুনো ভীষণ মুশকিল। প্রথম দিন শেষেই তাই প্রশ্নটি উঠে যাচ্ছে, তৃতীয় দিনে গড়াবে তো এই টেস্ট!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৬৬.২ ওভারে ১৭২ (জয় ১৪, জাকির ৮, শান্ত ৯, মুমিনুল ৫, মুশফিক ৩৫, শাহাদাত ৩১, মিরাজ ২০, সোহান ৭, নাঈম ১৩*, তাইজুল ৬, শরিফুল ১০; সাউদি ১/০, জেমিসন ০/৮, এজাজ ২/৫৪, স্যান্টনার ৩/৬৫, ফিলিপস ৩/৩১)।
নিউ জিল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ১২.৪ ওভারে ৫৫/৫ (ল্যাথাম ৪, কনওয়ে ১১, উইলিয়ামসন ১৩, নিকোলস ১, মিচেল ১২*, বস্নান্ডেল ০, ফিলিপস ৫*; শরিফুল ০/০, মিরাজ ৩/১৭, তাইজুল ২/২৯)।