বাঙালির ভাষার মাসে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। সোমবার ছিল মেলার ১২তম দিন। কর্মব্যস্ত দিন হওয়ায় এ দিন মেলার শুরুতে মানুষের উপস্থিতি ছিল খুব কম। তবে বেলা গড়াতে গড়াতে দর্শনার্থী বাড়লেও বেচা-বিক্রি তেমন বাড়েনি। বিক্রয়কর্মীরা বলছেন, ছুটির দিন ছাড়া মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক কম হচ্ছে। বিক্রিও ছুটির দিনের তুলনায় অনেক কম। আর প্রকাশকরা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই মেলায় লোক সমাগম বেড়েছে, এটা ইতিবাচক। সবাই যে বই কিনবেন তা নয়। অনেকে বই দেখছেন, এতে করে বইয়ের সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে। এরও একটা ইতিবাচক দিক আছে।
তথ্য অনুযায়ী, বিচিত্র বিষয়ের বইয়ের সম্ভারে সেজেছে একুশে বইমেলা। সেই বাস্তবতায় অধিকসংখ্যক পাঠকের পছন্দের তালিকায় রয়েছে গল্প-উপন্যাস কিংবা কবিতার বই। কেউ বা পছন্দ করেন ঝরঝরে গদ্যের গল্পময় ভ্রমণকাহিনি। সেই সুবাদে মেলায় আসা পাঠকের কাছে সৃজনশীল বইয়ের কদর খুব বেশি। এর বাইরে রয়েছে ভিন্ন রকমের আরেক চিত্র। সিরিয়াস পাঠকদের মননের উৎকর্ষতার প্রতীকী সে ক্যানভাসে গবেষণাধর্মী মননশীল বইয়ের রয়েছে পৃথক পাঠক। রাষ্ট্র, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধসহ বিবিধ বিষয়ের অজানা অধ্যায়কে জানার তাগিদে তারা বেছে নেন বিষয়নির্ভর তথ্যবহুল ও গবেষণামূলক বই।
বাংলা একাডেমি জানিয়েছে মেলার ১২তম দিনের মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ১১৫টি বই। এ দিয়ে এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে গবেষণাধর্মী বই খুব কম বলে মনে করছেন তরুণ গবেষকরা। মননশীল পাঠক বইমেলার বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংগ্রহ করেন তাদের মননের উপযোগী গ্রন্থটি। তবে মেলায় অংশ নেওয়া ছয় শতাধিক প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান মননশীল বই প্রকাশ করে থাকে। এসব বই ধীরে ধীরে মেলায় প্রকাশিত হবে বলে জানান প্রকাশকরা।
ফের তোপের মুখে মুশতাক-তিশা
এদিকে সোমবার অসম বিয়ের ঘটনায় আলোচিত খন্দকার মুশতাক-তিশা দম্পতি বইমেলায় গিয়ে আবারও তোপের মুখে পড়ে বইমেলা ছাড়েন। সোমবার বিকালে বইমেলায় নিজেদের বইয়ের প্রচারণায় গেলে দর্শনার্থীরা তাদের উদ্দেশে 'ভুয়া ভুয়া' স্স্নোগান ও নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এরপর নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তা নিয়ে মেলা থেকে বের হয়ে আসেন তারা।
এ সময় খন্দকার মুশতাক বলেন, 'বইমেলা একটি পবিত্র জায়গা। এখানে একজন লেখক-পাঠক হিসেবে আমার আসার অধিকার রয়েছে। যারা এসব করেছে, তারা পাঠক না। তারা মেলায় এসেছে এমন কান্ড ঘটানোর জন্য। আমি সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ দিয়েছি।'
তিশা বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন মানুষ বলছে, আমাদেরকে মেরে ফেলতে চায়। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বলব, আমার নিরাপত্তা কোথায়? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি আমার নিরাপত্তা চাই।'
এর আগে, ৯ ফেব্রম্নয়ারি বইমেলায় গিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মেলা থেকে বের হয়ে যান মুশতাক ও তিশা। সোমবার ফের একই ঘটনা ঘটেছে।
নতুন বই ১১৫টি
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সোমবার বেলা ৩টায় শুরু হয় বইমেলা এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এ দিন কবিতা-গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি মিলিয়ে মোটা ১১৫টি বই মেলায় এসেছে।
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি :হেনা দাস' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবাইদা নাসরীন। আলোচনায় অংশ নেন ঝর্ণা রহমান এবং ফওজিয়া মোসলেম। সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
প্রাবন্ধিক বলেন, 'হেনা দাস আজন্ম এক প্রতিবাদী সত্তা-একজন শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, ঈর্ষণীয় সংগঠক। নির্লোভ শুভ্রতার প্রদীপ হয়েই তিনি আলো ছড়িয়েছেন এবং সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে মানুষের জন্য পথ উন্মোচন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে একজন সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। এজন্য ঔপনিবেশিক শাসন, শ্রেণি ও লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। মহিলা সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, গণনাট্য সংঘ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হেনা দাস নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন।'
আলোচকরা বলেন, 'বিপস্নবী হেনা দাস ছাত্রজীবন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। নারী আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মানুষের মধ্যে থেকে আজীবন তিনি বিপন্ন মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। কোনো বাধাই তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সব বাধা উপেক্ষা করে দৃঢ়চিত্তে নিজের আদর্শের পথে অগ্রসর হয়েছেন হেনা দাস। বিপস্নবী চেতনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন সৃজনশীল মননের অধিকারী একজন মানুষ।'
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, 'বিপস্নবী হেনা দাস অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সারাটি জীবন। তার প্রতিটি কাজে দৃঢ় মনোবল ও সংগ্রামী আদর্শের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। আমাদের জীবনে, মননে এবং সুন্দর সমাজ গড়ার আন্দোলনে বিপস্নবী হেনা দাস সবসময় স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন।'
লেখক বলছি মঞ্চ
সোমবার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, কবি ফারহানা রহমান, গবেষক মিলটন কুমার দেব এবং কথাসাহিত্যিক ইকবাল খন্দকার।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, সাজ্জাদ আরেফিন, ওমর কায়সার, ইউসুফ রেজা, আসাদ কাজল, শাহেদ কায়েস এবং সারমিন মতিন মিতু। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী মদিনা, পলি পারভীন, জালালউদ্দীন হীরা।
এছাড়াও ছিল নাজিয়া জাবীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'স্পর্শ ফাউন্ডেশন', ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন 'কথা আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র' এবং মো. সজীব মিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'হাওলা'র পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন- শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া, সাইদুর রহমান বয়াতি, জহির আলীম, আবুল বাসার আব্বাসী এবং বশির উদ্দিন সরকার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম কুমার সরকার (তবলা), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি), খোকন বাউলা (দোতারা) এবং মেহেদী হাসান রনি (বাংলা ঢোল)।
আজকের অনসুষ্ঠান
আজ বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্' শীর্ষক স্মারক অনুষ্ঠান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। আলোচনায় অংশ নেবেন- হরিশংকর জলদাস এবং ফারজানা সিদ্দিকা। সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।