শনিবার, ০১ জুন ২০২৪, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ভালোবাসা দিবসে চট্টগ্রাম

সাজ সাজ রব সৈকত-পার্কে

ইব্রাহিম খলিল ও নুরউদ্দীন খান সাগর, চট্টগ্রাম অফিস
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাজ সাজ রব সৈকত-পার্কে

ভালোবাসার রঙে নতুন করে সেজে উঠেছে চট্টগ্রামের সব বিনোদনকেন্দ্র ও পতেঙ্গা সৈকত। মাসব্যাপী ফুলউৎসব চলছে নগরীর ডিসি পার্কে। তরুণ-তরুণীদের পদচারণায় জমেও উঠেছে এই উৎসব। এরই মধ্যে আজ একই সঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস। দিনটিকে ঘিরে এ বছর চট্টগ্রামে কোটি টাকার ফুলবাণিজ্যের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর দর্শনার্থীর পদচারণায় বিনোদনকেন্দ্র ও সৈকত মুখরিত হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন বিনোদনকেন্দ্র ও সৈকত পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিতরা।

চট্টগ্রামের প্রকৃতিপ্রেমীদের ধারণা, ভালোবাসা দিবসে ডিসি পার্কে ঢল নামবে তরুণ-তরুণীদের। যদি এমনটা হয়, তাহলে মানুষের চাপ সামলাতে কতটুকু প্রস্তুত এই ডিসি পার্ক। এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আশরাফুল আলম বলেন, 'মাসব্যাপী ফুলউৎসব ঘিরে নানা আয়োজন চলছে ডিসি পার্কে। ফুলউৎসবের মাঝখানের বিশালাকার পুকুরে চলছে কায়াকিং। পুকুরের দুই পাশে ডালিয়া, চন্দ্রমলিস্নকা, ম্যাগনোলিয়া, শিউলি, হাসনাহেনা, কামিনী, বেলি, চেরীসহ দেশি-বিদেশি ফুলের সমারোহ। লাখো ফুলের সমাহারে প্রাকৃতিক রূপে মুগ্ধ দর্শনার্থী ও অতিথি সবাই। ফুলউৎসবের এই মেলায় উচ্ছ্বাসিত অনুপ্রাণিত ফুলপ্রেমী দর্শনার্থী সবাই। উৎসবে আগত সাধারণ জনতা আনন্দে যেন মাতোয়ারা। প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত ডিসি পার্ক।'

এরই মধ্যে ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে ডিসি পার্কটিকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে নানা কাজ করা হয়েছে। চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই সাজানো হয়েছে অনুষঙ্গগুলো। ডালিয়া, চন্দ্রমলিস্নকা, ম্যাগনোলিয়া, শিউলি, হাসনাহেনা, অপরাজিতা, চেরী, জাকারান্ডা, উইলো, উইস্টেরিয়াসহ দেশি-বিদেশি ১২৭ প্রজাতির কয়েক লাখ ফুলের সমারোহে সেজেছে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে সাগর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ এলাকায় গড়ে তোলা ডিসি পার্ক।

মঙ্গলবার হাঁটতে হাঁটতে ফুলের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন হাটহাজারি উপজেলা থেকে আসা ফাতিমা জাহান সোহানা। তিনি বলেন, 'এ নিয়ে দুইবার আসলাম। অন্যরকম সুন্দর লাগছে। এ যেন এক ফুলের রাজ্য। এই রাজ্যে এখন ফুটতে শুরু করেছে টিউলিপ ফুল। ফুলের সমারোহের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এখন টিউলিপ। ভালোবাসা দিবসে বান্ধবীদের নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা রয়েছে।'

সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার কেএম রফিকুল ইসলাম বলেন, 'ডিসি পার্কে এখন প্রতিদিন ৫০ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী আসছে। ভালোবাসা দিবসে এই সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। সে হিসেবে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। ডিসি পার্কে এ দিন আসা দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানাতে চাই আমরা।'

তিনি বলেন, 'দর্শনার্থীদের বিশেষ আকর্ষণের জন্য ২ মাস আগে নেদারল্যান্ডস থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টিউলিপ ফুলের বীজ আনা হয়েছে। গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেনকে দিয়ে এখানে টিউলিপের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এখন ছাউনির ভেতর টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে লাল, হলুদ, গোলাপি ও সাদা রঙের টিউলিপ।'

এই আয়োজনকে আরও আকর্ষণীয় করতে ফুলের প্রদর্শনীর পাশাপাশি কয়েকটি সেলফি জোন ও পর্যটকদের জন্য থাকছে সাম্পান বাইচের আয়োজনের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, দোলনা, স্প্রিং টয়, মেরিগো রাউন্ড, দোলনা, পেস্ন-পেন, ফুট ট্রাম্পোলাইনসহ থাকছে নানা আয়োজন। আয়োজন ঝাঁকজমকপূর্ণ করতে থাকছে মাল্টি কালচারাল বিশেষ আয়োজন ঘুড়িউৎসব, ফায়ার ওয়ার্কস, ভায়োলিন শো, পুতুল নাচ, জাদু প্রদর্শনী। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার শিল্পীদের পরিবেশনায় থাকছে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

চট্টগ্রামের বিনোদনকেন্দ্রগুলোর অন্যতম হচ্ছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। এই সৈকতে প্রবেশে নেই কোনো ফি। নেই কোনো বাধা। তাই এই স্পটে এমনিতেই দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার দর্শনার্থীর ভিড় জমে। তবে দর্শনার্থী ঘিরে এই সৈকতে জমে ওঠে নানারকম আসবাব-তৈজসপত্র ও খেলনার বেচাকেনা। এসব বেচাকেনার বড় বাজার রয়েছে এখানে।

বাজার কমিটির সভাপতি মো. ওয়াহিদুল আলম বলেন, 'চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে পতেঙ্গা সি-বিচে। এখানে সাগরের ঢেউ আর দক্ষিণা হাওয়ায় মাতাল হয়ে উঠেন প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীরা। তাই এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রচুর দর্শনার্থী জমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতকে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের আকর্ষণ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কারণ, এই সৈকতে গড়ে উঠছে বন্দরের বে-টার্মিনাল ও বঙ্গবন্ধু টানেল। এতে সৈকতের পরিধিও বেড়েছে। ফলে এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে এই সৈকতে দুই লাখের মতো দর্শনার্থী আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।'

চট্টগ্রামে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানার অন্যতম আরেক কেন্দ্র হচ্ছে ফয়েস লেক। এই লেকের উপব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, 'এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নতুন করে সাজানো হচ্ছে এই লেককে। লেকে লাখো দর্শনার্থীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে এমিউজমেন্ট পার্ক এবং সি-ওয়ার্ল্ড। এই লেকে তিন শতাধিক রাইড রয়েছে। এ ছাড়া পাহাড়ঘেরা এই লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। আশা করছি, এবার উপচেপড়া ভিড় জমবে এই লেকে।'

লেকের পাশেই রয়েছে জেলা প্রশাসন পরিচালিত চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানায় এখন দর্শকদের কাঙ্ক্ষিত প্রাণীর অভাব নেই। রয়েল-বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, বিভিন্ন প্রজাতির বানর, হনুমান, উলস্নুক, ভালস্নৃুক, সাপ, হরিণ, ধনেশ পাখি, হাতিসহ ৭৩ প্রজাতির ৬২০টি পশুপাখি রয়েছে। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কিছু পশুপাখি। ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে চিড়িয়াখানাকে আকর্ষণীয় করতে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ।

চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, 'ভালোবাসা দিবসে দর্শনার্থীদের নজর কাড়তে চিড়িয়াখানাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। স্বাভাবিক সময় চিড়িয়াখানায় ৪-৭ হাজার, সরকারি ছুটির দিন ১০ হাজার পর্যন্ত মানুষের ভিড় জমে। ঈদে বা ভালোবাসা দিবসের মতো বিভিন্ন দিবসে সেটা দিগুণ পর্যন্ত দাঁড়ায়।'

তিনি জানান, চিড়িয়াখানায় প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। শিশুদের কোনো ফি নেই। তবে আশা করা হচ্ছে, এবার ভালোবাসা দিবসে দর্শনার্থীদের ভিড় রেকর্ড অতিক্রম করবে। আমি চাই, এবারের ভালোবাসা হোক পোষা প্রাণীর প্রতি।

চট্টগ্রামের আরও একটি বিনোদনেরকেন্দ্র হচ্ছে বহদ্দারহাট স্বাধীনতা কমপেস্নক্স। যার জন্ম হয়েছিল মিনি বাংলাদেশ হিসেবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় জাদুঘরসহ ঐতিহ্যবাহী সব জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শনে গড়ে তোলা হয়েছে এই কমপেস্নক্সে। ফলে মিনি বাংলাদেশ রাখা হয় এই কমপেস্নক্সের নাম। রয়েছে ঘূর্ণায়মান টাওয়ারও। যেখানে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে অবলোকন করা যায় পুরো চট্টগ্রাম শহর।

বিনোদনের আরেক জগত হচ্ছে জাম্বুরী পার্ক। যেখানে প্রতিদিন বিকালে ৮-১০ হাজার মানুষের মেলা বসে। এই পার্কেও রয়েছে বিশাল লেক। যেখানে ছোট ছোট বোটে ঘুরে বেড়ানো যায় অনায়াসে। ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে এই পার্কে চলছে ধোয়া-মোছা, রংকরা, আলোকসজ্জার কাজ। এ ছাড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো হচ্ছে।

এ ছাড়াও প্রস্তুত নগরের পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত প্রজাপতি পার্ক, আগ্রাবাদ কর্ণফুলী শিশুপার্ক, আগ্রাবাদ জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘর, গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত, পারকি সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র। বিনোদনকেন্দ্র ও উন্মুক্ত স্থানে বেড়ানো নিরাপদ করতে প্রস্তুত স্থানীয় প্রশাসনও।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'ভালোবাসা দিবসে দর্শনার্থীদের প্রচুর চাপ থাকবে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও নির্বিঘ্ন বিনোদনের ব্যবস্থা করতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। সব বিনোদনকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা থাকবেন। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন।'

অন্যদিকে, নগরীর ফুলের রাজ্য খ্যাত জামাল খান এলাকার মোমিন রোডে অবস্থিত ফুলের দোকানগুলোতে বিচিত্র রঙের ফুলের সমাহার। দ্বাদশ নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় গত বছরের চেয়ে এবার ফুল বিক্রি বেশি হবে- এমন ধারণা ব্যবসায়ীদের। সে হিসেবে গতবারের চেয়ে দোকানে তিনগুণেরও বেশি ফুল তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, ১৪ ফেব্রম্নয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রধান আকর্ষণই হলো ফুল। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে প্রায় সব বয়সের মানুষ এদিন ফুল উপহার দেন প্রিয়জনকে। দিবসটি এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই ফুল ব্যবসায়ীরা সারাবছরই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন দিনটির জন্য।

চট্টগ্রাম ফুল ব্যবসায়ী দোকান মালিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. নাছের গনি চৌধুরী বলেন, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর ফুল বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছি। দ্বাদশ নির্বাচনের পর এবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো। যে কোনো উৎসবে মানুষ ভালোভাবে অংশ নিতে পারছেন। তাই ভালোবাসা দিবসে ফুলের বিক্রিও ভালোই হবে বলে আশা করছি।'

এই ব্যবসায়ী নেতা জানান, ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে চট্টগ্রাম ফুল ব্যবসায়ী দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির অধীন ২৭০টি দোকানে দেশ-বিদেশে ৪-৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করা হবে। এই ফুলগুলো আসে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে, বিশেষ করে যশোর, ঢাকা, চকরিয়া, দোহাজারী, চন্দনাইশ, হাটহাজারী ও নাজিরহাট এলাকায় চাষ করা বাগান থেকে। এ ছাড়া বিদেশ থেকেও এই দিনের জন্য ৫০ লাখ টাকার ফুল আনা হয়েছে। যার বেশির ভাগ এসেছে চীন থেকে।

এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও ভারত থেকে ফুল আনা হয়েছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি ফুল হলো- চীনা গোলাপ, মাম, কার্নেশন, জারবেরা, সাদা গোলাপ, হলুদ গোলাপসহ আরও কয়েক ধরনের ফুল।

ফুলচাষি ও বিক্রেতা গফুর হালি বলেন, 'এবার দেশি ফুলের কদর বেড়েছে সে কারণে দামও বেড়েছে। এবার পাইকারিভাবে গেদা ১০০০টি ২৫০ টাকা, জিপসি প্রতি আঁটি ১৫-২০ টাকা, চন্দ্রমলিস্নকা প্রতিটি তিন-চার টাকা বিক্রি হচ্ছে। অন্য দিকে চায়না গেদা প্রতি ১০০টি চার থেকে ৫০০ টাকা এবং চায়না বেলি বিক্রি হচ্ছে প্রতি ১০০টি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়।

তিনি জানান, এবার শুধু চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকেই একুশে ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা করছেন ফুল ব্যবসায়ীরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে