শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ইসলামপুরে কাপড়ের বাজারও জমেনি

কেরানীগঞ্জের পোশাকপলস্নীতে তেমন বেচাকেনা নেই!

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

এবারের ঈদকে ঘিরে কাঙ্ক্ষিত বেচাকেনা নেই দেশের সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাকের পাইকারি বাজার ঢাকার কেরানীগঞ্জের পোশাকপলস্নীতে। পোশাকের দাম বৃদ্ধি ও আর্থিক সংকটের কারণে বেচাবিক্রি কম বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা। এ ছাড়া রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ডের ঘটনার প্রভাব পড়েছে এই পোশাকপলস্নীতেও। এতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, মালামাল বিক্রি করতে না পারায় হতাশ ব্যবসায়ীরা।

পাইকাররা জানিয়েছেন, এখানকার ১৩০টি মার্কেটে রয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি শো-রুম। বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এই পোশাকপলস্নী থেকে অভ্যন্তরীণ পোশাকের প্রায় ৮৫ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয়। গত বছরের তুলনায় এবার পোশাকের দাম বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় উৎসবের কেনাকাটা অনেকটা ধানের মৌসুমের ওপর নির্ভরশীল। তারা বলছেন, সাধারণত শবেবরাতের আগে থেকেই ঈদ বাজারের ব্যস্ততা শুরু হয় বিক্রেতাদের। কিন্তু এ বছর বেচাকেনা জমেনি এখনো। ব্যবসায়ীদের দাবি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে ঈদ বাজারেও। কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় কমেছে খুচরা ক্রেতা। যারা আসছেন, তারাও কিনছেন প্রয়োজনের তুলনায় কম।

সোমবার (২৫ মার্চ) সরেজমিন

ঘুরে দেখা যায়, শুভাঢ্যা ও আগানগর ইউনিয়নের চরকালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, কালীগঞ্জ, আগানগর, নাগরমহল ও ইস্পাহানি এলাকায় গড়ে ওঠা পোশাকপলস্নী প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। বিভিন্ন বিপণি-বিতানে সাজানো রয়েছে রংবেরঙের জামাকাপড়। দোকানের প্রবেশমুখে কর্মচারীরা ক্রেতার আশায় চেয়ারে বসে আছেন। কেউবা ক্রেতা দেখলে দোকানে আসার জন্য হাঁকডাক দিচ্ছেন। দোকানিদের কেউ কাপড় গুছিয়ে রাখছেন, কেউবা পাইকারদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে বেশির ভাগ দোকানি অলস সময় পার করছেন। ক্রেতাসমাগম না থাকায় কর্মচারীদের মুঠোফোনে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে।

জেলা পরিষদ মার্কেটের সোহাগ গার্মেন্টের স্বত্বাধিকারী সোহাগ ঢালী বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে। তাই জামাকাপড় কেনার প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ নেই। খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাদের চাহিদা কম থাকায় পাইকাররাও আসছেন না। তাই বেশির ভাগ রোজা অতিবাহিত হলেও আশানুরূপ বেচাবিক্রি হয়নি। শাহীন প্যান্ট হাউসের ব্যবস্থাপক শাহীন আলম বলেন, তাদের দোকান থেকে বঙ্গবাজারের কয়েকশ ব্যবসায়ী প্যান্ট কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ডে ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এর প্রভাব তাদের পোশাকপলস্নীর ওপরও পড়েছে। এতে তার ১০-১৫ লাখ টাকার বিক্রি কমে গেছে। এখনো দোকানে ও গুদামে অনেক মালামাল রয়েছে। সেগুলো বিক্রি করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, গেঞ্জি, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা ও বোরকা মান ভেদে পাইকারি বিক্রিতে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। অথবা পাঞ্জাবি হাউসের কর্ণধার মামুন দেওয়ান বলেন, রমজান উপলক্ষে বিক্রি আগের বছরের চেয়ে কম। গতবারের তুলনায় এবারের বিক্রি অনেক কম। এর আগের বছরগুলোতে পাঞ্জাবি বিক্রি শুরু হতো শবেবরাতের আগে থেকে। কিন্তু এবার ১৩-১৪টা রোজা হয়ে গেল, কিন্তু বিক্রি নেই। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিনিসপত্রের যে দাম, মানুষের জীবন চালানোই কঠিন। সেখানে মানুষ কাপড় কিনবে কীভাবে। স্টার পয়েন্টের কর্মচারী মাসুদ রানা বলেন, এ বছরের মতো খারাপ অবস্থা গত ১৫ বছরেও হয়নি। এ বছর বিক্রি নেই বললেই চলে। গত বছরের তুলনায় এ বছর কাপড়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। সারাদিন ধরে দোকানে বসে আছেন, কোনো ক্রেতা নেই। তারা মূলত শার্ট-প্যান্ট বিক্রি করেন। তিনি বলেন, সব জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সে জন্য মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই হিমশিম অবস্থা। তাই কাপড়ের দিকে মানুষের ঝোঁক কম এ বছর। পাইকারি ক্রেতা খলিলুর রহমান বলেন, তিনি বরিশালের বানারীপাড়া থেকে প্যান্ট, শার্ট ও পাঞ্জাবি নিতে এসেছেন। কিন্তু এসে দেখলেন, শার্ট-প্যান্টের দাম আগের থেকে অনেক বেড়েছে। যে শার্ট-প্যান্ট গত বছর নিয়েছেন ৭০০-৮০০ টাকা, সেই একই মানের কাপড় এ বছর ১,০০০-১,২০০ টাকা। গত বছরের থেকে এ বছর খুচরা বিক্রিও কম হচ্ছে। ময়মনসিংহ থেকে শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ও বাচ্চাদের পোশাক কিনতে এসেছেন রেজাউল করিম। তিনি বলেন, প্রতি পিস পাঞ্জাবি ১০০-১৫০ টাকা বেড়ে গেছে। এভাবে বাড়লে বিক্রিও কমে যাবে। দাম বাড়ায় কম করেই কাপড় কিনছেন চট্টগ্রাম থেকে আসা ক্রেতা আবু রিয়াদ। তিনি জানান, পাঞ্জাবি প্রতি প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে। এদিকে পার্ক ল্যান্ডের ম্যানেজার সাব্বির হোসেন বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর কাপড়ের দাম পিস প্রতি ৩০-৫০ টাকা করে বেড়ে গেছে। গত বছরের তুলনায় এই বছর বেচা-কেনার পরিমাণ অনেক কম। মানুষের চাহিদা বেড়ে গেছে, কিন্তু সেই হিসাবে বেতন অল্প। সেই টাকা দিয়ে খাদ্য ও অন্য জিনিসের প্রয়োজন মেটাতে কষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে ক্রেতাদের কাপড় কেনার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আজকে সকাল-বিকাল পর্যন্ত তাদের ৩,০০০ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। তাদের দোকানে রোজ কর্মচারীদের ইফতার বাবদ খরচ হবে কমপক্ষে ১,৫০০ টাকা। কর্মচারীর বেতন, দোকানের ভাড়া, লাইট খরচসহ আরও বিভিন্ন ধরনের খরচ আছে। বলতে গেলে ব্যবসার অবস্থা এই বছর খুব খারাপ। আলম মার্কেটের এলবি ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বলেন, কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় গেঞ্জি প্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সীমিত লাভে পণ্য বিক্রি করতে চাইলেও ক্রেতারা কিনতে রাজি হচ্ছেন না। গত বছর বেচাবিক্রি ভালো ছিল। অন্যান্য বছর এই সময় পণ্যের স্টক (গুদামজাত) শেষ হয়ে যায়, তবে এবার তেমন বিক্রি নেই

এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুসলিম ঢালী বলেন, বঙ্গবাজারের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী তাদের পোশাকপলস্নী থেকে জিন্স প্যান্ট ও গেঞ্জি কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর ক্রেতারা না আসায় সেই প্রভাব তাদের পোশাকপলস্নীতেও পড়েছে। আবার এমনিতেই তৈরি পোশাকের কাঁচামালের দাম বেশি। এতে গতবারের তুলনায় এবার পোশাক তৈরিতে বেশি খরচ হয়েছে। এবার ঈদে ব্যবসায়ীরা যে আশা নিয়ে পণ্য উৎপাদন করেছেন, সেই তুলনায় কম বিক্রি হয়েছে।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি স্বাধীন শেখ বলেন, রোজার ঈদ এখানকার ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় মৌসুম। সারা বছর পোশাক তৈরি করে ঈদের এই মৌসুমে বিক্রি করা হয়। অন্যান্য বছর শবেবরাতের পর থেকে ১৫ রমজান পর্যন্ত সব পোশাক বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর এখনো তেমন বিক্রি হয়নি। ডলারের দাম বৃদ্ধি ও এলসি সংকটে বিদেশি পোশাক আমদানি হয়নি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও তাদের ব্যবসা জমবে- এমন আশা করেছিলেন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা, তা নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে।

ইসলামপুরে কাপড়ের বাজারও জমেনি

দেশের কাপড়ের পাইকারি মার্কেট ইসলামপুরের বিক্রমপুর গার্ডেন সিটি, গুলশান আরা সিটি কমপেস্নক্স, চায়না মার্কেট, নবাববাড়ি মার্কেট, ইসলামপুরের হাজি শরফুদ্দিন ম্যানশন, হাজি ইউসুফ ম্যানশন, আমানউলস্নাহ কমপেস্নক্স, লতিফ টাওয়ার, এ মাবুদ রাইন টাওয়ার, লায়ন টাওয়ার, মদিনা ভবন, হাজি শামসুদ্দিন ম্যানশন, হালিম পস্নাজা, সোনার বাংলা মার্কেটসহ আশপাশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বাহারি পোশাকে সুসজ্জিত প্রতিটি দোকান। বছরের অন্যান্য সময় যেমন বেচাকেনা থাকে ঠিক, এখনো প্রায় একই রকম রয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান শুরু হওয়ার আগেই যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ হয়ে যায় তাদের। রোজার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতারা আসতে শুরু করেন। কিন্তু এবার রমজানে ১৪ দিন পার হলেও গতবারের তুলনায় দেখা মিলছে না ক্রেতাদের।

গত বছর যে ব্যবসা হয়েছে, এর চেয়ে এ বছর অনেক কম হয়েছে মন্তব্য করে ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেছারুদ্দিন মোলস্না জানান, মূলত সার্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলার দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বাড়া, এলসি খুলতে না পারা, মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ভরা মৌসুমে জমে ওঠেনি কাপড়ের পাইকারি বাজারটি। তিনি আরও জানান, যা ব্যবসা হবে, সেটাও হচ্ছে না চিরচেনা ইসলামপুরের যানজটের কারণে। এর মধ্যে আবার রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। ফলে যানজট আরও তীব্র হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার সভায় ইসলামপুরের যানজট নিরসনে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। তিনি আরও বলেন, রাস্তা সংস্কারের কাজ যেন রমজান মাসে শুরু না করা হয়। তবে ব্যবসায়ীদের আশা, দুই-একদিনের মধ্যেই ক্রেতা সমাগমে জমে উঠবে বাজার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে