শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়ক

ঈদযাত্রায় যানজটের আশঙ্কা চালক-যাত্রীদের

থ্রি-হুইলারের দাপট কমেনি, প্রশাসনের দায়সারা প্রস্তুতি, ভোগান্তি বাড়াবে সিঙ্গেল রোড
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ঈদযাত্রায় যানজটের আশঙ্কা চালক-যাত্রীদের

আসন্ন ঈদযাত্রায় বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে তীব্র যানজটের আশঙ্কা করছেন চালক-যাত্রীরা। এতে ঈদ ছুটিতে মহাসড়কের সাড়ে ১৩ কিলোমিটার এলাকায় দুর্ভাবনার কারণ হতে পারে যানজট। মহাসড়কে সেতুর পূর্ব প্রান্তে প্রায় ৮ কিলোমিটার সিঙ্গেল রোড ও যাত্রাপথে এ অবস্থায় আসন্ন ঈদযাত্রা নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবহণ চালক-যাত্রীরা। ইতোমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বরাবরের মতো দায়সারা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে কড়া নির্দেশনার পরও মহাসড়কে থ্রি-হুইলার ও বালুবাহী স্থানীয় ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। তবে যানজট যাতে না হয় সেজন্য সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং পুলিশ বিভাগ সড়ক সংস্কারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা বলছেন, চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে এলেও ঈদকে কেন্দ্র করে এলেঙ্গা থেকে সেতু পর্যন্ত ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলতে হবে। এতে ধীরগতির এক পর্যায়ে যানজট হতে পারে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে ৬৫ কিলোমিটার এলাকা টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন হয়েছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যানবাহনগুলো চার লেনের সুবিধায় কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পর্যন্ত সহজেই আসতে পারে। এলেঙ্গা থেকে সেতুর টোলপস্নাজা পর্যন্ত দূরত্ব সাড়ে ১৩ কিলোমিটার। এলেঙ্গা-রংপুর চার লেন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ না হলেও এলেঙ্গা থেকে সেতুর দিকে আড়াই কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুর পূর্ব প্রান্তের গোল চত্বর থেকে জোকারচর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়ক চার লেন করা হয়েছে। মাঝে প্রায় আট কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক রয়ে গেছে। এবারের ঈদযাত্রায় ওই আট কিলোমিটারে তীব্র যানজটের আশঙ্কা করছেন সড়ক ও পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। তবে যানজট যাতে না হয় সে জন্য সওজ এবং পুলিশ বিভাগ সড়ক সংস্কারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

পরিবহণ মালিক-শ্রমিক সমিতি ও হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়ক উত্তরের গেটওয়ে হিসেবে পরিচিত। এ মহাসড়ক দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ১৬ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচটিসহ মোট ২৬ জেলার ১১৬টি রুটের যানবাহন চলাচল করে। উত্তরের পথে ঈদের ছুটিতে রাজধানী থেকে অনেক গাড়ি একসঙ্গে বের হয় বলে আশুলিয়া, বাইপাইল, সাভার ও চন্দ্রায় যানজট হয়। তবে চন্দ্রার পর টাঙ্গাইলের অংশ থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৬০-৬৫ কিলোমিটার গতিতে চালকরা গাড়ি চালিয়ে আসতে পারে।

পরিবহণ শ্রমিকরা জানান, যেকোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন ঈদে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে এ মহাসড়কে যানজট হবে। প্রতিদিন অতিরিক্ত হাজারো গাড়ি টোল পরিশোধ করে সেতু পারাপার হবে- তাই যানজট এড়ানোর সুযোগ নেই।

ঢাকা-রংপুর রুটের বাস চালক ছানোয়ার হোসেন জানান, যানজট কমাতে গত বছরও ভূঞাপুর সড়ককে বাইপাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু লাভ হয়নি। এলেঙ্গা হয়ে ভূঞাপুর সড়ক সরু হওয়ায় যানজটে গাড়ি আটকে ছিল। যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছিল।

ঢাকা-রাজশাহী রুটের বাসচালক খোকন মিয়া জানান, ২-৩ কিলোমিটার নয় বরং পুরো মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হলেও ঈদের আগে-পরের পরিস্থিতির কোনো হেরফের হবে না। কারণ সেতুতে টোল দিতে গাড়ি দাঁড় করাতেই হবে। তবে ঈদের আগে-পরে অস্থায়ীভাবে টোলপস্নাজা দ্বিগুণ বা তিনগুণ করা হলে ভিন্ন কথা- অন্যথায় যানজট নিরসনের কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) সূত্র জানায়, ঈদ মৌসুমে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপস্নাজায় নিরবচ্ছিন্নভাবে টোল আদায় করা হয়। স্বাভাবিক সময়ে ১৮-২০ হাজার যানবাহন চলাচল করলেও ঈদের আগে-পরে তা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ঈদের আগে ও পরে ১০-১২ দিন প্রতিদিন একটানা ৫০-৬০ হাজার গাড়ি সেতু পারাপার হয়ে থাকে। তার ওপর মোটর সাইকেলের চাপ রয়েছে। টোলপস্নাজার সড়কে আসার পর গাড়ির গতি কমে যায়। এবার ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ভোগান্তি লাঘবে টোলবুথ বাড়ানো এবং মোটর সাইকেলের জন্য পৃথক টোলবুথ বসানোর কথা রয়েছে।

এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাজ্জাদুর রহমান জানান, গত বছরের অভিজ্ঞতায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে সেতু পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়ক ওয়ানওয়ে এবং উত্তর থেকে ঢাকামুখী যানবাহনগুলো সেতু পার হয়ে পুরাতন ভূঞাপুর সড়ক দিয়ে বাইপাস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার রবিউল ইসলাম জানান, ঈদের আগেই সেতুর পূর্ব প্রান্তের কাজ যতটা সম্ভব শেষ করা হবে। ইতোমধ্যে ৮-৯ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। তারা আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রম্নত নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের মতে, ঈদের সময় নানা কারণে মহাসড়কে যানজট হয়। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম। প্রধানত যাত্রীর চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় ট্রিপ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ট্রিপ দিতে গিয়ে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ চালক, টানা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর কারণে চালকের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি-অবসাদ এবং যানবাহন বৃদ্ধি, সড়কে ত্রম্নটিযুক্ত লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা রং করা যানবাহন ও অসচেতন যাত্রীদের তাড়াহুড়ো- মূলত এসব কারণেই ঈদে মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ঈদযাত্রায় যাত্রীসহ সব অংশীজনদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। হাইওয়ে পুলিশকে অনেক বেশি কর্মতৎপরতা দেখানো প্রয়োজন। এসব করা গেলে ঈদের আগে-পরে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

টাঙ্গাইলের ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) রফিকুল ইসলাম সরকার জানান, যানবাহনের চাপ বেশি হলে এলেঙ্গা থেকে উত্তরবঙ্গগামী সড়ক একমুখী (ওয়ানওয়ে) করে দেওয়া হবে। তখন উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী যানবাহন সেতু পার হওয়ার পর ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সিনথিয়া খান জানান, ঈদকে সামনে রেখে সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সংস্কার করা হচ্ছে। যানবাহনের চাপ বাড়লে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর ঢাকাগামী যানবাহন ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ বিভাগ। এজন্য ভূঞাপুর-এলেঙ্গা এবং নিকরাইল-গোবিন্দাসী সড়কের সংস্কার করা হচ্ছে। নিয়মিত এ কাজ তদারকি করা হচ্ছে। ২-১ দিনের মধ্যে এ সংস্কার কাজ শেষ হবে।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরফুদ্দীন জানান, বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে টাঙ্গাইল জেলার অংশে ৬৫ কিলোমিটার পড়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সড়কের প্রায় ৮ কিলোমিটার অংশ তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর সাত শতাধিক পুলিশ মহাসড়কে মোতায়েন থাকবে। ঈদে মানুষ নির্বিঘ্নে যাতে ঘরে ফিরতে পারে সেজন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, সড়ক ও সেতু সচিব ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোলবুথের সংখ্যা বাড়ানো, মোটর সাইকেলের জন্য আলাদা টোলবুথ করাসহ বেশ কিছু উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

'ঈদযাত্রায় সিঙ্গেল রোডে গাড়ি থামানো যাবে না'

এদিকে, ঈদযাত্রায় বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে মহাসড়ক পরিদর্শন করে গণশুনানি ও মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উলস্নাহ নুরী বলেছেন, মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে সেতুর টোলপস্নাজা পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র সাত কিলোমিটার এলাকায় চার লেনের কাজ চলছে। আসন্ন ঈদযাত্রায় ওই সাত কিলোমিটার এলাকা সিঙ্গেল সড়কে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। ওই সাত কিলোমিটারে কোনো গাড়ি থামানো যাবে না। ওখানের প্রতি কিমিতে ১০ জন করে দায়িত্বশীল ব্যক্তি সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকলে এ সমস্যা এড়ানো সম্ভব হবে। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় প্রশাসন, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক সমিতিসহ অংশীজনদের সহযোগিতা কামনা করেন।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রোববার দুপুরে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০২৩-২৪ এর আওতায় ঈদযাত্রা ও সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণশুনানি ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের টোলপস্নাজায় টোলবুথ বাড়ানো, মোটর সাইকেলের জন্য আলাদা দুটি টোলবুথ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ওই সভায় জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বাসেক) বঙ্গবন্ধু সেতু অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল, টাঙ্গাইল সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী সিনথিয়া আজমিরী খান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরফুদ্দিন, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ, চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে সাইট ম্যানেজার মো. রবিউল আউয়াল, টাঙ্গাইল জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. বালা মিয়া প্রমুখ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে