সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ভূমধ্যসাগরে মৃতু্য

'বাজানের স্বপ্ন লাশ হইয়া ফিরা আইলো'

যাযাদি ডেস্ক
  ০৪ মে ২০২৪, ০০:০০
ভূমধ্যসাগরে নৌকায় নিহত মামুন শেখের লাশ দেশে এসেছে, ছেলেকে হারিয়ে মাতম করছেন তার মা। ছবিটি শুক্রবার সকালে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রাম থেকে তোলা -সংগৃহীত

'আমার বাজানে আমাগো ভালো রাখতে চাইছিল। আমাগো জন্য নতুন ঘর বানাইয়া দিব। লাখ লাখ টাকা আয় করব। আমার বাজানের বুক ভারা কত স্বপ্ন ছিল। সবকিছু শ্যাষ হইয়া গেল। বাজানের স্বপ্ন লাশ হইয়া ফিরা আইলো। হায়রে কপাল আমার!' শুক্রবার সকালে আহাজারি করতে করতে এভাবেই মৃত সন্তানের স্বপ্নের কথা বলছিলেন মা হাফিজা বেগম।

মাদারীপুর রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের স্ত্রী হাফিজা বেগম। তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে নৌকায় দালালদের নির্যাতনে আট বাংলাদেশি মারা গেছেন। মামুন শেখ (২২) ওই আট বাংলাদেশির মধ্যে একজন। আটজনের মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈরের বাসিন্দা। বাকি তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের।

মামুন শেখের বড়ভাই সজীব শেখ বলেন, 'আমার ভাইয়ের লাশটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। একবার তিউনিসিয়ায় ময়নাতদন্ত হয়েছে, এরপরও আমাদের দেশে এটা করার প্রয়োজন

ছিল না। বাড়িতে সবাই লাশের জন্য অপেক্ষা করছে।'

মারা যাওয়া আটজন হলেন মাদারীপুরের রাজৈরের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), সেনদিয়ার গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪), কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার (২২), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন মিয়ার ছেলে রিফাদ (২১), ফতেয়পট্টি এলাকার মো. রাসেল (২০) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইসরুল কায়েস আপন (২২)।

স্বজনেরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে সৌদিয়া এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দের মরদেহগুলো পৌঁছায়। তখন মরদেহ নিতে ভিড় করেন তারা। কিন্তু ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহগুলো পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।

এদিকে শুক্রবার সকালে রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল এলাকায় মামুন শেখের বাড়িতে গিয়ে লোকজনের ভিড় দেখা যায়। সবাই ঢাকা থেকে লাশ ফেরার অপেক্ষায় আছেন। অনেকেই অশ্রম্নসিক্ত। মামুনের মা হাফিজা বেগম কিছুক্ষণ পর পর সন্তানের স্মৃতি মনে করে হাউমাউ করে কান্না করছেন। প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

প্রতিবেশী সুমন শেখ বললেন, 'মামুন ছেলে হিসেবে অনেক ভদ্র ছিল। চেয়েছিল সফল হতে। পরিবারে সচ্ছতা ফেরাতে তার এই বিদেশযাত্রা। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। মামুন লাশ হয়ে এভাবে দেশে আসবে, সেটা কখনো প্রত্যাশা করিনি আমরা।'

সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বেশ কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। প্রথমে তারা দুবাই হয়ে উড়োজাহাজে করে লিবিয়া পৌঁছান। পরে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি লিবিয়া থেকে দালালদের মাধ্যমে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন তারা। মাঝপথে তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে যাওয়া পথে তাদের নির্যাতন করা হয়। এতে রাজৈরের কোদালিয়ার সজীব কাজী, পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামে মামুন শেখ, সেনদিয়ার সজল বৈরাগী, কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস, কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রিফাদ, রাসেল ও আপনের মৃতু্য হয়। এ ছাড়া এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা যান। খবর পেয়ে কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা শুক্রবার ঢাকার বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ৩০ জন যেতে পারবেন- এমন একটি ছোট নৌকায় ৫২ জনকে নিয়েছিল দালালেরা। যে আটজন মারা গেছেন, তাদের নৌকার পাটাতনের নিচে জোর করে রাখা হয়েছিল। তারা অক্সিজেন-সংকটের কারণে পাটাতন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু দালালেরা তাদের মারধর করে আবার সেখানে পাঠান। এভাবে নির্যাতন ও অক্সিজেন-সংকটের কারণেই তাদের মৃতু্য হয়েছে।

স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ ও সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন। ঘটনার পর থেকেই দালাল চক্রের সদস্যরা আত্মগোপনে রয়েছেন।

নিহত সজীবের বাবা মিজানুর রহমান কাজী বলেন, 'ছেলে মারা গেছে ফেব্রম্নয়ারি মাসে, এখন মে মাস। লাশ দেশে এলো দেরি করে, তারপরও ভোগান্তি। কখন আমার ছেলের মুখটা দেখতে পাব, সবাই লাশের জন্য অপেক্ষা করছি।'

রাজৈর থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার বলেন, তিউনিসিয়ায় দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আইনগত সহযোগিতা চাইলে করা হবে। এরই মধ্যে সরকারিভাবে লাশগুলো দেশে এসেছে। পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে