সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সংকটেও স্বপ্ন দেখাচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং

ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন তথা টাকা জমা দেওয়া ও উত্তোলন করার জন্য সাধারণ মানুষকে এখন আর জেলা কিংবা উপজেলা শহরে যেতে হয় না। হাতের নাগালেই পাচ্ছেন ব্যাংকিং সুবিধা
এম সাইফুল
  ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সংকটেও স্বপ্ন দেখাচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং

তারল্য সংকটের মধ্যেও দেশের এজেন্ট ব্যাংকিং খাত এগিয়ে চলছে। হাতের কাছে আউটলেট থাকায় গ্রামীণ জনগণ যুক্ত হচ্ছেন ব্যাংকিংয়ে, পিছিয়ে নেই নারীরাও। টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে গ্রাহকদের নেই কোনো অভিযোগ। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এজেন্ট ব্যাংক। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শতভাগ মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির স্বপ্ন দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত প্রায় তিন লাখ ৯৮ হাজার ১৩৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলো এজেন্ট ব্যাংকিং। দেশের ব্যাংক খাতে চলমান নানা সংকটের মধ্যেও চাঙ্গা রয়েছে এজেন্ট আউটলেটগুলো। ব্যাংকে তারল্য সংকট কাটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে এসব প্রান্তিক এজেন্ট। দিন দিন বাড়ছে এজেন্টের সংখ্যা।

1

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন তথা টাকা জমা দেওয়া ও উত্তোলন করার জন্য সাধারণ মানুষকে এখন আর জেলা কিংবা উপজেলা শহরে যেতে হয় না। হাতের নাগালেই পাচ্ছেন ব্যাংকিং সুবিধা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের এজেন্ট ও আউটলেট থেকে ঋণ সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে।

তথ্য মতে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হিসাবধারীর সার্বিক সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়ে দুই কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছেছে। আমানত হয়েছে প্রায় তিন লাখ ৯৮ হাজার ১৩৬ লাখ টাকা।

একাউন্ট সংখ্যা এক বছরে বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। আমানত বেড়েছে ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ত্রৈমাসিক বৃদ্ধি যথাক্রমে চার দশমিক ৬২ শতাংশ ও ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আমানত ও ঋণে এজেন্ট ব্যাংক ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদেন বলা হয়, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শুধু এপ্রিল থেকে জুনে নারীদের আমানতের হার বেড়েছে চার দশমিক ৮১ শতাংশ। ঋণের পরিমাণ কমেছে শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন মাসের এজেন্ট ব্যাংকিং পরিসংখ্যানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিতে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে মোট আমানতের ৪৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ নারী, ৪৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও বাকি এক দশমিক ৫৫ শতাংশ আসে 'অন্যান্য' থেকে। নারীর সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক প্রবণতা।

বর্তমানে দেশে দুই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ২১ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আট ইসলামী ব্যাংকের সমন্বয়ে ৩১ ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে।

২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১৫ হাজার ৯৯১ এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত ২১ হাজার ৪৭৩ আউটলেট ছিল। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন দশমিক শূন্য নয় শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে।

এজেন্ট ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দ্রম্নত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রেমিট্যান্স আহরণ অনেক সহজ হচ্ছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এজেন্ট ব্যাংক। গ্রামের সহজ-সরল ও নিরক্ষর মানুষ শহরের ব্যাংকের শাখাগুলোতে যেতে ঝামেলা মনে করে. তাই হুন্ডি কিংবা অন্য অবৈধ পথে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাতেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এখন হাতের কাছে গ্রামের বাজারের এজেন্ট আউটলেট থেকে সহজেই টাকা উত্তোলন কিংবা জমা রাখতে পারছে সাধারণ মানুষ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সঠিকভাবে পরিচালনা করলে দেশের প্রত্যেক ঘরে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, টাকা স্থানান্তর (দেশের ভেতর), রেমিট্যান্স উত্তোলন, বিভিন্ন মেয়াদি আমানত প্রকল্প চালু, ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল পরিশোধ, বিভিন্ন প্রকার ঋণ উত্তোলন ও পরিশোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সরকারি সকল প্রকার ভর্তুকি গ্রহণ করা যায়। তবে এজেন্টরা বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত কোনো লেনদেন করতে পারেন না। এ ছাড়া এজেন্টদের কাছ থেকে কোনো চেকও ভাঙানো যায় না। মোট লেনদেনের ওপর পাওয়া কমিশন থেকেই এজেন্টরা আয় করেন।

এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। ত্রৈমাসিক হিসাবে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ কমেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হিসাবধারীর সার্বিক সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়ে দুই কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছেছে। আমানত হয়েছে প্রায় তিন লাখ ৯৮ হাজার ১৩৬ লাখ টাকা।

একাউন্ট সংখ্যা এক বছরে বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। আমানত বেড়েছে ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ত্রৈমাসিক বৃদ্ধি যথাক্রমে চার দশমিক ৬২ শতাংশ ও ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ঋণের সংখ্যা ও মোট বকেয়া ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।

বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমানত ও ঋণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এপ্রিল-জুনে বেড়েছে যথাক্রমে চার দশমিক ৮২ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ।

একদিকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। অন্যদিকে শাখাবিহীন ব্যাংকিংয়ে ঝুকছে ব্যাংকগুলো। এতে ব্যাংকের পরিচালন খরচ কমেছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রচার ও প্রসার। শাখা না থাকলেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন সারাদেশের মানুষ ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো বিকল্প সেবার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।

দেশের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতেই ২০১৪ সালে চালু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম। এ জন্য বাড়তি চার্জ গুনতে হয় না গ্রাহককে। ব্যাংকের ডেবিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগও পাচ্ছেন তারা। ফলে এই সেবা দ্রম্নতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরিচালন ব্যয় কম হওয়ায় এখন ব্যাংকগুলোও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্রাহক সংখ্যা, সেইসঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী এখনো ব্যাংক সেবার বাইরে। তাদের এই সেবার আওতায় আনতে এজেন্ট ব্যাংকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বেড়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত করতে এজেন্ট ব্যাংকিং আগামী দিনে আরও বড় ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সঠিকভাবে পরিচালনা করলে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের অর্থে সিংহভাগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সুযোগ করা গেলে তা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে আরও শক্তিশালী ও সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন তারা। আগামী দিনে সেই চেষ্টাই করা হবে বলেও জানান তারা।

উলেস্নখ্য, ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারির পর ২০১৪ সালে প্রথম এ সেবা চালু করে ব্যাংক এশিয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে