সরকার বাজেটের চলমান ১০টি প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল, কিছু প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ৩৭২টি চলমান প্রকল্পের মধ্যে ৬৭টি প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় স্কিম বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রশ্নবিদ্ধ এসব প্রকল্পের মধ্যে একটি কেরানীগঞ্জের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। সূত্রের তথ্যনুযায়ী, ২০১৯ সালে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নের প্রধান সড়ক প্রশস্তকরণ ও সংস্কারের জন্য ২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল। দেখা গেছে, এ প্রকল্প চলমান থাকার পরও কেরানীগঞ্জ উপজেলায় রাস্তা উন্নয়নের জন্য আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। অথচ কেরানীগঞ্জ এলাকাটি আগের প্রকল্পের আওতায় ছিল। এক হাজার ৯০ কোটি টাকার এ নতুন প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি অর্থ ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তবে অনুমিত বাজেটের তুলনায় এ খরচ অনেক বেশি করা হয়েছে বলে জানা যায়। এমন ১০টি প্রকল্প বিভিন্ন অসংগতির কারণে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া অন্যান্য প্রকল্প
বাতিলের প্রস্তাব পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩৪৯ কোটি টাকার হাওর ফ্লাইওভার ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ২৬টি প্যাকেজের মধ্যে মাত্র একটি সম্পন্ন হয়েছে। এর দুটি প্যাকেজ অনুমোদন পেয়েছে, আটটির কাজের আদেশ জারি হয়েছে এবং নয়টি এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পরিবেশগত প্রভাব পুনর্মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি স্থগিত রাখতে হবে।
এর বাইরে বারহাট্টা উপজেলায় ২৬ কোটি টাকার শিশু পার্ক নির্মাণ প্রকল্প এবং ফরিদগঞ্জের ১০৭ কোটি টাকার ডাকাতিয়া নদী সেতু প্রকল্প জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। একইভাবে, সুনামগঞ্জের মহসিন নদীর ওপর ৫০ কোটি টাকা বাজেটের পাগলা সেতু প্রকল্পটিও ব্যয়-সুবিধার অনুপাত পুনর্মূল্যায়নের জন্য পর্যালোচনাধীন রয়েছে।
মেহেরপুরে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ২১০ কোটি টাকার বাজেট নির্ধারিত হলেও এটি স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ, যশোরে ইতোমধ্যেই একটি অনুরূপ গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এখনো শুরু হয়নি। এছাড়াও, ৪৫৪.৮৩ কোটি টাকা বাজেটের বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ইলিয়ট ট্রম্নডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রকল্পটি বাতিলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ অন্যান্য সরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যেই অনুরূপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু রয়েছে।
এছাড়াও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বের অভাব উলেস্নখ করে পরিকল্পনা কমিশন ১,৯০৩.৫৩ কোটি টাকার মুজিব কিলস্না নির্মাণ, মেরামত এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব করেছে। অগ্রগতির অভাবে বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে যশোর শেখ জহুরুল হক পলস্নী উন্নয়ন একাডেমির জন্য ১৯৮.৯৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপের কারণে মহাদেবপুর (নওগাঁ) সাইলো নির্মাণ প্রকল্প (৩৬৭.৫২ কোটি টাকা) এবং মডার্ন রাইস সাইলো নির্মাণ প্রকল্প (১,৪০০ কোটি টাকা) বাতিল করা হয়েছে।
এবিষয়ে এলজিইডির কর্মকর্তারা জানান, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর চাপে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে এমন প্রকল্প গ্রহণ একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এলজিইডি এবং পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, তারা প্রায়ই রাজনৈতিক চাপের কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিতে বাধ্য হতেন। পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ৩১ অক্টোবর এবং ৬ নভেম্বর কৃষি, পানিসম্পদ ও পলস্নী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও অগ্রাধিকার তালিকা ইতোমধ্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব স্কিম বা প্রকল্প বাতিল করা হবে বলে জানান তিনি।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর 'আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে অনেক প্রকল্প বা স্কিম নেওয়া হয়েছিল' উলেস্নখ করে জানান, প্রকল্প নির্বাচনে ঠিকাদারদের প্রভাব ছিল। এ ধরনের প্রকল্প চিহ্নিত করতে চলমান প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও অন্তর্বতী সরকারের শ্বেতপত্র কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে এ ধরনের প্রকল্পের কথা উলেস্নখ করা হয়েছে।
কমিশনের পর্যালোচনা
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পলস্নী প্রতিষ্ঠান বিভাগের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুসারে, এলজিইডির ৯৮টি চলমান প্রকল্পের মধ্যে ৫২টি প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন, পাবনা ও বগুড়ার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) জন্য নতুন দরপত্র না দিয়ে বিদ্যমান কাজগুলো সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সময়মতো প্রকল্প শেষ করতে স্কিমগুলো পর্যালোচনা করে প্রাসঙ্গিক প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উলেস্নখ করা হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাইন ব্রিজ কনস্ট্রাকশন প্রকল্পে যেসব ঠিকাদার কাজ করছে, তাদের বরাদ্দকৃত কাজ শেষ করতে হবে। তবে অনির্ধারিত প্যাকেজগুলো আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ এবং অন্যান্য জেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে সময়মতো শেষ করতে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কুমিলস্না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চাঁদপুরের মতো জেলাগুলোতে প্রকল্প স্কিমগুলো সাইটে পর্যালোচনা করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাতটি প্রকল্প, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে তিনটি করে প্রকল্প এবং মৎস্য অধিদপ্তর ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি করে প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।