দেশে এখন চালের ভরা মৌসুম, আমদানিও স্বাভাবিক; তারপরও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ভারত থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে গত এক মাসে শুল্কমুক্ত ৬ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন চাল আমদানি হলেও বেনাপোলসহ যশোরের বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। স্থানীয় বাজারে চালের দাম তো কমেইনি বরং কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। আগে যেসব ক্রেতা চিকন চাল কিনতেন তারা এখন বাধ্য হচ্ছেন মোটা চাল কিনতে। একপ্রকার জোর করে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, আপাতত চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন ধান-চালের ভরা মৌসুম, কৃষকের ঘরে উঠেছে আমন ধান। তারপরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই চাল কিনে খেতে হচ্ছে।
জানা যায়, সরকার ভারত থেকে চালে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৬ জানুয়ারি এক মাসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৬ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার গত ১৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুমোদন দেয় তিন লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির। পরে তা বাড়িয়ে চলতি মাসের ১৫ জানুয়ারি করা হয়েছে।
বেনাপোল চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আবু তাহের জানান, মাহবুবুল আলম ফুড প্রডাক্ট, অর্ক ট্রেডিং, সর্দার এন্টারপ্রাইজসহ ৮টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বেনাপোল বন্দর দিয়ে এ চাল আমদানি করেছে। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন চাল বেনাপোল দিয়ে আমদানি হয়েছে। এ পর্বে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় ৯২টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। এতে দুই লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল এবং এক লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এই স্বল্প সময়ের মধ্যে চাল আমদানি করতে পারেনি। সরকার মাত্র ২৫ দিন সময় নির্ধারণ করে দেয় আমদানিকৃত চাল বাজারজাত করার জন্য। পরে তা ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়ায়। ধীরগতিতে চলছে চাল আমদানি। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল ভারত থেকে আমদানি হলে শিগগিরই হয়তো চালের দাম কমে আসবে।
চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দাম- এমনটাই বলছেন অটোরাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকদের মতে, ভারতে চালের দাম বেশি, এ কারণে আমদানিকৃত চাল কম দামে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। ভরা মৌসুমেও কম দামে চাল না কিনতে পেরে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। সীমান্ত অঞ্চলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় চালের মূল্য কমছে না বলে মনে করছেন সাধারণ ক্রেতারা। বিশেষ করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় মূল্য কমছে না বলে মত তাদের।
যশোরের শার্শা ও বেনাপোল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সিংহভাগ ধানের উৎপাদন হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে এই অঞ্চলে ২১ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ ধান ঘরে উঠে গেছে। এবার ধানের বাজারও চড়া। ১৩৫০ থেকে ১৪৫০ টাকা মণে দাম পাচ্ছেন কৃষক। এ অঞ্চলের বেশ কয়েকটি অটোরাইস মিল ঘুরে দেখা যায়, এখনো ধান কিনতে পারেননি মিল মালিকরা। কৃষকরা তাদের ধান বাজারজাত করতে পারেননি এখনো। তবে মিল মালিকরা অন্য জেলা থেকে ৩২-৩৪ টাকা কেজি দরে ধান কিনে আনছেন। এসব ধান থেকে মোটা চাল প্রস্তুত করতে খরচ পড়ছে ৫২ টাকা এবং চিকন চাল প্রস্তুত করতে কোনোটা ৬৩ টাকা, আবার কোনোটা ৭৩ টাকা পড়ছে।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কমুক্ত চাল বাজারে আসলেও দামে কোনো প্রভাব পড়েনি বেনাপোলসহ আশপাশের বাজারগুলোতে। বেনাপোল বাজারের অন্যতম পাইকারি ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন, বর্তমানে মোটা চাল ৫২ টাকা, হীরা চাল ৪৮ টাকা, উনপঞ্চাশ চাল ৫৬ টাকা, আঠাশ চাল ৫৮-৬০ টাকা, জিরা মিনিকেট ৭৫, রড মিনিকেট ৬৫ টাকা, ইন্ডিয়ান মিনিকেট ৭৫ টাকা, বাসমতি ৯০, পাইজাম ৫৬ টাকা, স্বর্ণা ৫৫ টাকা ও নাজিরশাইল ৮০ টাকা কেজি দরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
নাভারণ বাজারের সবচেয়ে বড় চালের আড়ত চৌধুরী রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী রাশেদ চৌধুরী বলেন, 'হাইব্রিড মোটা চাল ৫১ টাকা ও স্বর্ণা মোটা চাল ৫৩ টাকা কেজি পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে। নতুন ধানের চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এখন থেকে চালের দাম কমতে থাকবে। যদিও এবার অতিবৃষ্টির কারণে চালের উৎপাদন কমেছে। সে কারণে চাল আমদানির প্রভাবও বাজারে থাকবে।'
বেনাপোল বাজারে চাল কিনতে আসা মিলন হোসেন বলেন, 'এখন ধানের মৌসুম, আবার ভারত থেকে গাড়ি গাড়ি চাল আমদানি হচ্ছে। তারপরও চালের দাম কমছে না কেন? প্রতিবছর এ সময় নতুন ধান উঠলে বাজারে চালের দাম অনেক কমে যায়। কিন্তু এবার বাজারের চিত্র উল্টো।'
চাল ক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, 'দেশে পর্যাপ্ত ধানের আবাদ হয়েছে। তারপরও দাম কমছে না কেন? আমরা গরিব মানুষ, দাম না কমলে কীভাবে চলবো? হয়তো সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। তাই আমি মনে করি, প্রশাসন বাজারে নজরদারি করলে দাম অনেকটা কমে যাবে।'
বেনাপোল চেকপোস্ট উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপসহকারী কর্মকর্তা শ্যামল কুমার নাথ বলেন, 'গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি এক মাসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৬ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন শুল্কমুক্ত চাল আমদানি হয়েছে। যেহেতু চাল একটি নিত্যপণ্য এবং দেশের বাজারে চাহিদা ব্যাপক, সেহেতু আমরা- বন্দর এবং কাস্টমস মিলে সব কার্যক্রম দ্রম্নত সম্পন্ন করছি। সরকার চাল আমদানির সময়সীমা বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।'